এলোগেইছকে বললাম, আগামীকাল আমি আসব এবং একসাথে বিদ্রোহের ছক আঁকব। আমার আগমন নিশ্চিত করেই তবে তার ওখান থেকে বেরোলাম। তাকে এই ধারণায় তৃপ্ত করলাম যে, আমি তোমার ফাঁদে আটকে গেছি।
সকালে আমি চীফ পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাছে গেলাম। তাকে বললাম, এলোগেইছ, ফ্লোরা ও মরিয়ম অমুক স্থানে আত্মগোপন করে আছে। তাদেরকে আজ রাতেই গ্রেফতার করা সম্ভব। আমি ওখানে গিয়েছিলাম; সে কথা বলিনি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমি এ সংবাদ অবগত হয়েছি বললাম তাকে একথাও।
মনসুর ইবনে মোহাম্মদ জঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি ভিখারীর ছদ্মবেশে এক গোয়েন্দাকে প্রেরণ করেন। এদের গতিবিধির প্রতি ন্যর রাখতে বলেন। আরো বলেন, এলোগেইছ ও তার সাথী দু মেয়ে কোথাও বেরোলে তাদের অগোচরে খেয়াল রাখবে। কোথায় যায়, কি করে সবার প্রতি নযর দেবে। রাতে এসে জানাবে।
পরদিন জানতে পারলাম ফ্লোরা ও মরিয়মকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এলোগেইছ পালাতে সক্ষম হয়েছে। হামলাকারী পুলিশদের সাথে এমনও দুলোক ছিলেন যারা ফ্লোরা ও মরিয়মকে চিনতেন। নির্দিষ্ট বাড়ীতে তারা আগমন চলিলে বাড়ীওয়ালারাও পুলিশের ওপর চড়াও হয়। গ্রামের লোকজন হৈ হুল্লোড়ে বেরিয়ে আসে। জনগণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে পুলিশ ইন্সপেক্টর ঘোষণা করেন, একজনও সামনে এলে গোটা জনপদ জ্বলে ছাই করে ফেলব। ফ্লোরা ও মরিয়ম চিৎকার দিয়ে লোকালয়বাসীকে উত্তেজিত করে তোলে। ফ্লোরা চিৎকার দিয়ে বলে,
তোমাদের আত্মশ্রমের কি হলো কুশ পূজারীরা! এই মরিয়মকে দেখো! ইনি সন্ন্যাসিনী। তোমাদের ইজ্জতকে মুসলমানরা নিয়ে যাচ্ছে। খোদার বেটার কাছে কি জবাব দেবে?
মনসূর ইবনে মোহাম্মদ জানতেন, বিদ্রোহী জাতির লোকেরা অবশ্যই পুলিশদের সাথে লড়াই করবে। এজন্য তিনি সতর্কতামূলক অজস্র সেপাই সঙ্গে নিয়েছিলেন। জদের মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানে ফ্লোরা ও মরিয়মকে রাখা হলো। জনপদের বাইরেও একদল পুলিশ ছিল, প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহারের স্বার্থে।
ঐ দুকুলাঙ্গার যুবতাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসার প্রাক্কালে পুলিশ অফিসার কড়া ভাষায় ঘোষণা করলেন, কোন প্রকার প্রতিরোধ করলে গোটা জনপদে কিয়ামত কায়েম হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও কয়েকবার তীর বৃষ্টির সম্মুখীন হতে হল তাদের। পুলিশের হস্তক্ষেপে সে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। ফ্লোরা ও মরিয়মকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সুলতানা বললো, আমার যদুর বিশ্বাস-পথিমধ্যে ওই দুই যুবতী ছাড়া পাবার জন্য পুলিশ ইন্সপেক্টরকে নিশ্চয়ই কোন সুন্দর লোভনীয় প্রস্তাব রেখেছিল। স্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়া অন্য কিছুও।
না সুলতানা! আজীবন তুমি এই আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছ যে, নারীর মধ্যে যে শক্তি আছে পুরুষের মধ্যে তা নেই। ওরা তোমার মত নীতিজ্ঞানহীনা নয়, ধর্মোদ্দীপনাও মৌল বিশ্বাসে টইটুম্বুর ওদের মন মস্তিষ্ক। মরিয়ম পথিমধ্যে কাউকে কোনো প্রস্তাব দেয়নি, উল্টো ইসলামের বিরুদ্ধে যা তা বলেছে। বলেছে স্পেনীয় মুসলমানদের শান্তিতে বসবাস করতে দেব না।
তুমি অবাক হবে সুলতানা! তোমার কোন মৌলনীতি নেই। স্বার্থ-ই তোমার মূলনীতি। এদেশে এমন কিছু মা আছেন যারা তারিক বিন যিয়াদের মত সন্তান জন্ম দিয়েছেন যারা স্পেন জয় করেছেন। আবার এমন কিছু মা আছেন যারা এমনো সন্তান জন্ম দিয়েছেন যারা কেবল গদী আর ক্ষমতার চিন্তায় বিভোর। শেষের খান্দানের বাচ্চারা কেবল ক্ষমতা দখলের সবক পেয়ে আসছে। তুমি সেই খান্দানের একজন। তুমি ভাবতেও পার না, মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের ইজ্জত-আব্রকে সওদা করার প্রস্তাব একবারের জন্যও রাখেনি তারা।
পথিমধ্যে ওরা ইসলামকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়েছে। পরদিন তাদেরকে কাজীর দরবারে উঠানো হয়েছে। চীফ জাস্টিস ফ্লোরাকে বলছেন, তোমার শান্তি কেবল এই সুবাদে মাফ করছি যে, তুমি এক মুসলমান বাবার সন্তান। আমার যদুর ধারণা এই বন্দী দশা থেকে তুমি উপদেশ গ্রহণ করবে এবং সার্বিক পথে এসে যাবে।
ফ্লোরা তার মুখ বন্ধ করেনি। কাজী সাহেব এদেরকে দীর্ঘ কারাভোগের শাস্তি দেন। একবার সাদা শশ্রুমন্ডিত এক পত্রী কারাগারে তাদের সাথে দেখা করতে আসে। তাকে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু জেলদারোগা পরে ওই পাত্রীকে কয়েদখানা থেকে বের করে দেন। কেননা সে ফ্লোরাদের বলেছিল, ইস্পাত কঠিন থেকো। অচিরেই হেরেম থেকে তোমাদের ডাক আসবে।
বহুদিন পরে জানতে পারি এলোগেইছই পাদ্রীবেশে কয়েদখানায় এসেছিল। ফ্লোরা ও কয়েদখানায় মধ্যেই ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য গালিগালাজ শুরু করে দিলে আবারো তাদেরকে কাজীর দরবারে উঠানো হয়। বিজ্ঞ কাজী দেখলেন, এদের চিন্তা-চেতনা পূর্বের চেয়ে ক্রমশঃ অবনতি হচ্ছে। এবার তিনি স্বাভাবিক আইন প্রয়োগ করলেন। উভয়কে শূলে চড়িয়ে ফাঁসির হুকুম জারী করলেন।
উভয়কে মরণ ঘুমে ঘুম পাড়ানো হলো। এলোগেইছ প্রচণ্ড শক পেল, এক সাথে তার প্রতিশোধ বহি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। তার আন্দোলন চরম আকার ধারণ করল। খ্রীস্টানর খোলাখুলি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিলাম শুরু করল। অবশ্য তারা নতুন করে আর বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারল না। স্পেনের আমীর ফরমান জারী করলেন, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গালি দেয়ার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু। সুতরাং কমাসের ব্যবধানে ৮ হাজার খ্রীস্টানকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়া হলো। এলোগেইছ ফ্লোরার শোকে আধাপাগল। তাকেও এক সময় গ্রেফতার করে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হলো।