আবদুর রহমান যেন তার ওজর গুনেও শুনছেন না। তার দৃষ্টি সুলতানার চেহারায় নিবদ্ধ।
শাহী শিকার ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই আমার। তুমি কে? সুলতানাকে প্রশ্ন করেন আবদুর রহমান।
তুরুবের রাণী। সুলতানা আমার নাম।
কোন প্রদেশের রাণী? তুরু? আবদুর রহমান জিজ্ঞাসুনেত্রে সরকারী অফিসারদের দিকে তাকান।
তুরুব একটি জায়গীর; কোন প্রদেশ নয়। জনৈক অফিসার বললেন।
সুলতানা তাঁকে জানালেন যে, তার বাবা মারা গেছেন, তিনি এখনও কুমারী। ওই জায়গীরের মালিক।
সত্যি সত্যিই তুমি রাণী হতে পার। তুমি যুবতী। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ফায়সালা করার এখতিয়ার আছে তোমার। আমার যদুর বিশ্বাস, কি বলতে চাই আমি-তা তোমার অবোধগম্য নয়।
বুঝেছি স্পেনরাজ! এতটুকু ইশারা বুঝাবার মত জ্ঞান আছে আমার।
খানিকবাদে ঋীমায় দস্তরখানে খানা খাচ্ছিলেন সুলতানা। খাদ্য তালিকায় ছিল সদ্য শিকারকৃত হরিণ শাবকের রনি। আবদুর রহমানের খুশীর অন্ত নেই। যুৎসই শিকার মিলে গেছে তার। সুলতানার নিটোল মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি যেন অতৃপ্ত হৃদয়ের জ্বালা নিবারণ করে যাচ্ছিলেন অহর্নিশ।
***
জ্বালা নিবারণের এই পরম্পরা, আবদুর রহমান ইবনুল হাকামের ওপর ছায়া বিস্তার করে রইল। সুলতানা তার বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না বটে, কিন্তু হেরেম ও আবদুর রহমানের অন্দর মহল তার অধীনেই চলত। তিনি আবদুর রহমানকে ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে দেননি যে, প্রথম তার সাথে যে মোলাকাত হয় সে সময় তার ঘোড়ার গাড়ী চালক মিঃ এলোগেইছ তার কর্মচারী ছিল না। ওই ঘটনা ছিল সাজানো নাটক। সুলতানার চরিত্র সম্পর্কে এলোগেইছ বলছে,
ভুবন মোহিনী তার রূপ, সৌন্দর্য অনন্য। কুদরত বুঝি নিজ হাতে তাকে বানিয়েছিলেন। যেমন সুন্দরী এই নারী তেমনি চালাক ও প্রতারকও। আপাদ মস্তকে তার বুদ্ধি টইটম্বুর। যেমন পোষাকী তেমনি দেমাগী। ভাবখানা যেন এমন, রাজা বাদশাহরা তার কর্মচারী। তিনি আবদুর রহমানকে পাগল বানিয়ে ফেলেন। আমীরের এই দুর্বলতা ভালভাবেই উপলব্ধি করেন। একবার আবদুর রহমান তাকে খুশী করতে গিয়ে এত সোনা-দানা দান করেন যাতে খাজাঞ্চিখানা তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়।
একবার সুলতানা স্পেন আমীরের ওপর রাগ করে দরোজায় খিল এঁটে দেয়। তার বিরহে আবদুর রহমানের জীবন তেতো হয়ে ওঠে। পরিবেশ খাঁ খাঁ করে ওঠে। তিনি কবাদীর মাধ্যমে তাকে রাজী করিয়ে হেরেমে যেতে উদ্বুদ্ধ করান। কিন্তু সুলতানা অনড়। মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা তাঁকে বোঝান। সামান্য একা নারী এতই দাম্ভিক যে, সে হেরেমে থেকেও রাজার সম্মান বজায় রাখতে ভুলে গেছে। তারা বলেন, দরোজার বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হোক যাতে সে ভেতরেই দম আটকে মরে।
আবদুর রহমান এই পরামর্শ তো শুনলেনই না উপরন্তু উপদেষ্টাদের ওপর প্রচণ্ড রাগ করলেন। বললেন, যাও। তার কামরার সম্মুখে স্বর্ণমুদ্রার নূপ জমা করো। তার হুকুম তামিল হল। আবদুর রহমান দরজার কাছে গিয়ে সুলতানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দরজা খুলে দেব। এসব দৌলত তোমার। দরজা খুলে গেল। সুলতানা এই খেল-তামাশায় পাক্কা খেলুড়ে। তিনি বের হয়ে আবদুর রহমানের পায়ে পড়লেন, হাতে নামিয়ে দিলেন দুঠোঁট। ভাবখানা যেন এই তিনি বাদশাহর জন্য দেওয়ানা। দেওয়ানা তো বাদশাহ স্বয়ং, যিনি দেখে দেখলেন না যে, এই নারী কিসের পাগল। তিনি বাদশাহর হাতে চুমো দিলেন ঠিকই, এর পাশাপাশি বাদশাহকে কামরায় নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই সোনা-দানা ও মনি-মাণিক্যের থলেগুলোকে ঝুলিতে পুরলেন।
মহলে কানাঘুষা শুরু হল। হেরেমের নারীরা দাতে আংগুল কাটল।
সকলের মনে সুলতানার প্রভাব সঞ্চারিত হল। এরা সকলে আবদুর রহমানের সৌন্দর্য, সমর নিপুণতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কথা জানত। তারা এক্ষণে অনুধাবন করল, এহেন সিংহপুরুষকে যে কাবু করতে পারে, তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অলৌকিক গুণ কিংবা যাদু রয়েছে।
সবচেয়ে বেশী হতাশ হয়ে পড়ল ওই তিন নারী আবদুর রহমান যাদেরকে চক্ষুর আড়াল হতে দিতেন না। সুলতানা তাদের প্রিয় মানুষটিকে কুক্ষিগত করে নিয়েছে। নারীসুলভ ঈর্ষায় এরা জ্বলতে থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। সুলতানা একবার এদেরকে তার কামরায় ডেকে পাঠালেন। তিনজনই যেন অশেষ ঘৃণা নিয়ে হাজির হল। তারা তার ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা দেখল যা এক প্রকার বিজয়িনীর-ই টিপ্পনি বলা বলে।
তোমরা আমার নিকটে এসো। সুলতানা বললেন, আমি যদুর জানি এখানকার সকলের যবান আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সবকিছুই আমার কানে এসেছে। কিছু কথা তোমরাও বলেছ।
তিনজনই বে-চাইন হয়ে পড়ে। এটা ভীতিভাবের বহিঃপ্রকাশ। কারণ, সুলতানা তাদেরকে হেরেম থেকে বহিষ্কার করে দিতে পারে। স্পেনরাজ তার হাতের পুতুল। এমন কি এদের হত্যার হুকুমও জারী করাতে সক্ষম। তিনি আবারও বললেন,
তোমাদের চেহারায় চিন্তার ভাজ দেখছি যে তোমরা কি আমায় সতীন ঠাওরাচ্ছ? মন থেকে এমন চিন্তা মুছে ফেল। আমি আর যা কিছুই হই না কেন-তোমাদের মত এক নারীতে! নারীই বোঝে নারীর হৃদয়। আমি নিজে যেমন তোমাদেরকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না তেমনি করবে না তোমরাও। স্পেন রাজ্যের প্রতি ভালবাসা সবার তরে সমান। আজ তিনি মারা পড়লে কাল কোন বন্ধুবখশ তার স্থানে আমীর হলে আমরা চারজনই তার দাসী হব। তোমরা আমার পজিশন লক্ষ্য করেছ। আমি কি করতে পারিকি পারি না। তবে আমি হেরেমের কোন নারীর বিরুদ্ধে না যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি।