আমি প্রস্তুত। সুলতানা বললেন।
তাহলে এখন শোন- তোমার করণীয় কি? বলে এলোগেইছ বলতে আরম্ভ করলেন।
***
যে রাতে আবদুর রহমান সঙ্গীতজ্ঞ যিরাবের যাদুকরী সুর-মূর্ঘনায় ডুবেছিলেন এবং তার প্রিয় তিন বাদী তার চারপাশে ছিল যাদের একজনকে তিনি স্ত্রীত্বে নিয়েছিলেন, ঐ রাতেই তার সাধের স্পেনে এক নয়া ষড়যন্ত্রের কুটিল জাল বিস্তার করা হচ্ছিল। এ সেই আবদুর রহমান যিনি রণসিংহ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। যিনি ছিলেন খ্রিস্টবিশ্বের ব্রাস, যার দূরদর্শিতার সামনে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফ্রান্স সম্রাট দুই পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য ছিলেন। সেই আবদুর রহমানই রঙ্গরসের আসর সাজিয়ে আপনার বীরত্ব আর নারীমাংসমোহে গলা অবধি ডুবে ছিলেন। যে হাত এক সময় জাতির বীর গাযীদের সফলতায় তালি বাজাত সেই হাতই এখন নৃত্যশিল্পীর কোমর দোলানোয় স্পন্দিত হতে থাকল।
যিরাব ইরানী বংশোদ্ভূত। প্রকৃত নাম আলী ইবনে নাফে। উপনাম আবুল হাসান। তিনি ওই যুগের সাড়া জাগানো সংগীতবিশরিদ ছিলেন। সুগায়ক ইসহাক আল মোহলী মুকরীর শাগরেদ ছিলেন। যিরাবের কণ্ঠের গানে যে মাদকতা তা তার ওস্তাদদের মাঝেও ছিল কি-না মুশকিল। তিনি কেবল সঙ্গীত সম্রাট-ই নয়, ছিলেন হ্যান্ডসাম ও সুঠামদেহী। তিনি গেয়ে যেতেন শ্রোতারা মন্ত্রযুদ্ধের ন্যায় শুনত। গানের সুরে মানব হৃদয়কে কি করে কাছে টানতে হয় সে গুণটি ছিল তার মাঝে। জনগণের মাঝে এমনও একটা শ্রুতি ছিল যে, লোকটার কজায় হয়ত কোন গায়েবী শক্তি কিংবা জিন-ভূত আছে। কেননা এ বয়সের এক যুবকের মাঝে এ পরিমাণ যোগ্যতা থাকার কথা নয়।
তিনি আফ্রিকা চলে গিয়েছিলেন। আবদুর রহমানের পিতা আল হাকাম তার খ্যাতি শুনে ইহুদী গায়ক মারফত স্পেনে ডেকে পাঠান। যিরাব ঠিক তখনই কর্ডোভায় পৌঁছেন। যখন আল-হাকাম পরকালের পথ ধরেছেন এবং তার স্থানে তদীয় পুত্র আবদুর রহমান সিংহাসনে বসেছেন। যিরাবের হতাশ হতে হয়নি, কেননা আবদুর রহমানও তার পিতার মত সঙ্গীত পাগল ছিলেন। তিনি যিরাবকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানালেন। তিনি সামান্য দিনের ব্যবধানে প্রাসাদে প্রভাব বিস্তার করলেন। শুধু কি তাই! সঙ্গীতজ্ঞের পাশাপাশি নিজকে একজন আলেম, দার্শনিক ও তর্কবাগীশের কাতারে শামিল করলেন।
***
এর দিনদুয়েক পরে আবদুর রহমান শিকারে বের হলেন। যেদিকটায় হরিণের আনাগোনা বেশী সাধারণত সেদিকটায় তিনি বেশি যেতেন। সঙ্গে রাজকীয় গার্ড বাহিনী। আবদুর রহমান ঘোড়ার পিঠে। তীর হাতে সর্বাগ্রে তিনি। সন্নিকটে একটা সফেদ ঘোড়ার গাড়ী দেখা গেল। ওই গড়ীর কোচোয়ানের গতি আবদুর রহমানের দিকেই। আচমকা সে থেমে গেল। বোঝা গেল তার ঘোড় ভীত হয়েই ছুটছে। যমীন বন্ধুর। ঠাসা বৃক্ষরাজি। ঘোড়ার গাড়িটা বারবার পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। আবদুর রহমানের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা পড়ে। সহসাই তিনি গার্ড বাহিনীকে এই গাড়ির সাহায্যে ছুটে যেতে বলেন। ঘোড়ার গাড়ীটা তখন এলোপাথাড়ি ছুটছে তো ছুটছে। গাড়ী চালক লাগামশেষে টান মারে। ভেতরে শোনা যায় নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। গাড়ী চালক এই আর্তনাদে প্রভাবিত হয়ে প্রচেষ্টার পর প্রচেষ্টা চালিয়ে থামিয়ে ফেলে। তাকে সাহায্যে করে দেহরক্ষী বাহিনী।
গাড়ী থেকে পরমা সুন্দরী এক নারী বেরিয়ে এলো। সে দেহরক্ষী বাহিনীকে কৃতজ্ঞতা জানাল। তার ফুলে ফেঁপে ওঠা চোখ-মুখ নেপথ্যে বলে চলছে, সে বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চালকের অবস্থা তার চেয়ে সঙ্গীন। দেহরক্ষীরা জানাল, এটা স্পেনরাজের রাজকীয় শিকার ক্ষেত্র, এখানে আসার কারণ কি তোমাদের? তারা আরো বলল, তোমাদেরকে বর্তমান স্পেনরাজ দ্বিতীয় আবদুর রহমানের সামনে যেতে হবে। তারা আরো বলল, তোমাদেরকে বর্তমান স্পেনরাজ দ্বিতীয় আবদুর রহমানের সামনে যেতে হবে। তার হুকুমেই আমরা তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। উদ্ধার করে তোমাদের তার সামনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আছে।
দেহরক্ষীরা অগ্রে চলছে। গাড়ীতে অবস্থানরত নারী হাওদার মধ্যে থেকে চালকের দিকে তাকাল। সে কতকটা উপরে বসা।
এলোগেইছ! নারীকণ্ঠ ফিসফিসিয়ে ওঠল, সত্যিই কি আমাদের ঘোড়া ভয়ে অমন টগবগিয়ে ছুটছিল? আমার রক্ত তো শুকিয়ে যাবার মত অবস্থা।
এলোগেইছ হেসে বললেন, আমার কারসাজির প্রশংসা কর সুলতানা! ঘোড়া ভয়ে অমন করেনি। আমিই ইচ্ছাপূর্বক ওদের অমন করতে বাধ্য করেছি। যাতে রাজার দেহরক্ষীরা সাহায্যে ছুটে এসে আমাদের বন্দী করে নেয়। এক্ষণে ওরা তোমাকে তাঁর সমুখে নিয়ে চলেছে। সত্যি বলতে কি, সরকারী শিকার ক্ষেত্রে আনাগোনা অন্যায়। আমার সুনিপণ চাল তুমি দেখেছ। এবারের পালা তোমার।
***
এটা নিছক এলোগেইছের চাল। আবদুর রহমানের প্রাসাদে তারই এক লোক সংবাদ দিয়েছিল যে, অমুক দিন তিনি শিকারে বেরোচ্ছেন। সুলতানাকে পেশ করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে এই শিকারকে লুফে নিলেন তিনি। ইচ্ছে করেই ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে সুন্দরী সুলতানাকে পেশ করার চাল চাললেন। ঘোড়া প্রকৃতপক্ষে তার করায়ত্তেই ছিল।
সুলতানাকে যখন আবদুর রহমানের সামনে পেশ করা হল তখন গোস্বার স্থলে তার চেহারায় ফুটে ওঠল আনন্দদ্যুতি। ঠোঁটে পরিধি বাড়ানো মুচকি হাসি। সুলতানাদের পরিকল্পনা সফল। আবদুর রহমান এলোগেইছের-দিকে তাকালেন যিনি ছদ্মবেশে চালকের আসনে ছিলেন। তিনি এই বলে আসন থেকে নামলেন, অপরাধ আমার স্পেন সম্রাট! ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেছিলাম। তাছাড়া শাহী শিকার ক্ষেত্রের জ্ঞানও ছিল না আমার।