থামো। সৈনিক বলল, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার এজন্য তাকে শাস্তি দেয়া যায় না। তবে ইসলামের অপমান অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশের প্রচলিত আইনে তার সাজা হবে। তাকে আদালতে ওঠাব আমরা।
আদালতে ওঠানো হলে ফ্লোরা ইসলামের নামে আপত্তিকর অশ্লীল মন্তব্য করল। বিজ্ঞ কাজী বললেন, তুমি মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। সুন্দরী বলে তোমায় ছেড়ে দিয়ে আরেক ফেনার আশংকা রয়েছে।
বাবার, হৃদয়ে এবার সন্তানের প্রেম উথল উঠল। আর যাই হোক ফ্লোরা তার মেয়েতো। তিনি ঠিক আদালতের সামনে আর্জি পেশ করলেন, আদালত যদি তার ক্ষমা মঞ্জুর করে তাহলে আমি ওর জামিন নিতে পারি। ও আমার কলজের টুকরা। সঠিক রাস্তায় আনতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
আদালত এই আর্জি কবুল করছে। কিন্তু এক বছরের মত তাকে ঘরে নজরবন্দী করে রাখত্বে যুব। সেখানে থাকবে নারী-প্রহরা যারা তাকে দীক্ষা দেবে।
ফ্লোরাকে একটি ঘরে আটকে রাখা হলো। দেয়া হলো তার প্রহরা হিসেবে সুশিক্ষিতা তিন নারীকে। ফ্লোরা নির্লিপ্ত হয়ে গেল। সে কেবল জছে, পালানোর উপায়।
২.৩ জিদ্দী
ফ্লোরাকে তার বাবা খুব ভালবাসতেন। কলজের টুকরার প্রতি স্নেহ থাকাটাই স্বাভাবিক। তার মেয়ের মতো মেয়ে লাখে একটা। কিন্তু ফ্লোরা তার বাবার প্রতি তেমন ভালবাসা প্রদর্শন করেনি কোনোদিনও। ফ্লোরার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ বাবা তার স্ত্রীকে বলতেন, দেখে নিও তোমার মেয়েটা খুবই লাজুক হবে-আমার সাথে কথা বলতে পর্যন্ত লজ্জা পায়। কিন্তু এই নিরীহ বাবা কোনদিন জানতে পারেন নি মেয়ের নির্লিপ্ততার কারণ। জানতে পারেননি নেপথ্যে তার খ্রীস্টত্বের তালিমের কথা।
কাজীর বিচার শুনে বাবার কলিজায় তীরাঘাত হয়। তার শোক তিনি একে অধিক স্নেহ করতেন দ্বিতীয়ত সেই মেয়েই আবার মুসলিম বিদ্বেষী। নজরকাড়া কালনাগিনী তার ঘরেই কি-না পেলে-পুষে বড়।
কাজীর নির্দেশমত তিনজন ধার্মিক মুসলিম মহিলাকে নিয়োগ দেয়া হলো। ফ্লোরার বাবা লিখিত দস্তাবেজে সই দেন।
তিনি রাজী হলেন। মেয়ের এই পরিণতির ধকল সইতে না পেরে তিনি শয্যাশায়ী হন। শয্যা থেকে আর তার ওঠা হলো না। একদিন মারা গেলেন। ফ্লোরার ভাই বদর রাগে শোকে অগ্নিশিখা হয়ে বোনের কাছে এসে বলে,
বাবা তোর শোকে মারা গেছেন।
শোকে আরো মানুষও মারা যায়। তিনি আমার বাবা– এ মুহূর্তের আফসোস কেবল এতটুকু, কিন্তু তিনি মুসলমান মনে পড়লে আমার এই আফসোস তিরোহিত হয়ে যায়।
এর মানে এই যে, তুমি সঠিক পথে আসছো না?
আমি সঠিক পথেই আছি। তোমরা এক বছর অপেক্ষা করো না। এক বছর পর আমার জিবে এ কথাই শুনবে। কাজীকে বলো, আমাকে জল্লাদের কাছে সোপর্দ করতে। আমার পয়গম্বর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন আর আমি ফাঁসিকাষ্ঠে মরব। সত্য পথে থেকে সবার জন্য আমি তাকিয়ে আছি অধীর আগ্রহে।
তুমি জীবিত থাকবে ফ্লোরা মৃত্যুর দেখা পাবে না সহসাই। বাকী জীবন তোমাকে শ্ৰী ঘরেই কাটাতে হবে। জীবন্ত জাহান্নামে থাকবে। আমি তোমার ভাই। তাই শেষ করলাম আমার আখেরী দায়িত্ব। আমি বলতে চাই, বাতিলের ওপর থাকলে দুনিয়া-আখেরাতে শাস্তি পেতে থাকবে।
দুনিয়ার শাস্তি আমাকে আখেরাতের শান্তি থেকে বাঁচাবে। বলে ফ্লোরা পাহারাদার মহিলাদের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমাদের কি বলা হয়নি, এ ঘরে কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে পারবে না? এ লোক কি করে ঢুকল?
উনি তোমার ভাই বলে আমরা বাধা দেইনি। জনৈকা মহিলা বললেন।
আমার কাছে ও অপরিচিত। কোনো মুসলমান আমার ভাই হতে পারে না। বের করে দাও ওকে এ ঘর থেকে।
বদর বোনের নিষ্ঠুর কথায় আহত হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
***
মা! বদর মাকে বলল, আমার যা ধারণা, তুমিই ফ্লোরার দেমাগ খারাপ করেছ। বাবা বলেছেন, তুমি তার সাথে প্রতারণা করেছ।
শোনো বাবা! তোমার বাবাকে ধোকা দেইনি কোন দিনও। আমার কোনো আশ্রয় ও ঠিকানা ছিল না। তোমার বাবা আমার দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি তার সহধর্মিনী হলাম। একদিকে তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা অন্যদিকে আমার ধর্মের টান একসাথে দুটি ভালবাসাই আমি মনে পুষেছি। সেই ভালোবাসার অর্ধেকটা ফ্লোরাকে দিয়ে এসেছি আশৈশব। ধর্মশিক্ষা সেই ভালবাসার প্রতীক। এক্ষণে তোমার বাবা নেই। কাজেই এ ঘরের প্রতি আমার আর আকর্ষণ নেই। আমি তোমার ছোট বোনকে সাথে নিয়ে ঘর ছাড়ছি।
কোনো মা কি তার সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারেন যেভাবে যাচ্ছ তুমি? তোমার মমতা ও আবেগ মারা গেছে কি?
আমার সাথে যেতে চাইলে তুমি আমার ধর্মে এসে যাও। ধর্মের কারণে আমি আমার পুত্রকে কোরবান করতে প্রস্তুত।
আর আমিও ধর্মের কারণে আমার মা-বোনদের উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। চলে যাও ভোমরা। আমার ঘরে কাল নাগিনীদের ঠাঁই নেই। তোমাদের মুখ-দর্শনও করতে চাই না। বলে বাইরে চলে গেল। সন্ধ্যার পর সে ফিরে এলো। দেখল তার মা-বোন ঘরে ছেড়ে চিরদিনের তরে চলে গেছে।
অন্তরীণ অবস্থায় খামোশ ছিল ফ্লোরা, এতে প্রহরী তিন মহিলা বেশ স্বস্তি অনুভব করছিল। কোনো প্রকার জ্বালাতন না করাই তাদের স্বস্তির কারণ। ও বড় খেয়ালী, পাগল ও জেদী মেয়ে বলেই তাদের কাছে দেয়া হয়েছিল।
এক নারী তাকে জিজ্ঞেস করছিল, তোমার অপরাধ কি মা?।
আমার বাবা এক আইবুড়োর কাছে বিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাকে। লোকটা কেবল বুড়ো নয় মদ্যপও। সে আমার বাবাকে সওদা করেছিল। আমি বেঁকে বসলাম। এ ধরনের বুড়োকে পতি করতে কি তোমরা? বেঁকে বসার দরুন আমার এই ভাই আমাকে বেদম মারপিট করেছিল। বাবার মারও কি কম খেয়েছি। আমি উভয়কে গালিগালাজ করেছি। বাবা আমাকে ধরে কাজী সাহেবের কাছে নিয়ে যান। বলেন, ও আমার বেটি। ধর্মের অবমাননা করেছে। রাগে আমি নিজকে হারিয়ে ফেলি। বলল, এ অবস্থায় তোমাদের কি গো আসত না? মহিলা হলে তার গোস্বা আসার কথা। গোর দরুন কাজী ও বাবা দুজনকেই গালমন্দ করি। কাজী সাহেব ফায়সালা করেন, মেয়েটা বেজায় মুখরা। কয়েদখানায় না পাঠিয়ে তাকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হোক এবং তাকে সৎ-অসৎ শেখানো হোক।