ইজ্জত খোয়াতে হবে এই তো। কিন্তু আমি আমার কুমারীত্ব খোয়াতে চাই না। কুমারী মরিয়মের দাসী আমি। জানি, মুসলিম শাসক, সালার, আমীর-উজিররা সুন্দরী নারী রক্ত-মাংসের ঘ্রাণ পেলে নিজ দায়িত্ব ভুলতে বসে। কিন্তু কোনো মুসলমানের ঘ্রাণ নিতে পারব না আমি।
আমাকে ভাবতে দাও ফ্লোরা। এখানে তুমি নিরাপদ থাকবে। নিজকে সংযত কর, আবেগ তাড়িতের পরিণাম ভাল হয় না। বলে পাদ্রী হাশেমকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কোনো খবর,
পরিস্থিতি বিস্ফোরনোমুখ। আমি কর্মকার, আমি লোহা ঠাণ্ডা করা অপেক্ষা গরম করার পক্ষপাতী। লোহা কিভাবে গরম করতে হয় তা আমার জানা আছে। মাদি থেকে বহুলোক টলেডো পালিয়ে গেছে। আমার লোকজন ওখানে হাজির। ওরা নেতৃত্বে আমাকে চাইছে। ভাবছি কি করি।
ভেবো না হাশেম। পাদ্রী বললেন, প্রদেশটা তোমার। অতএব নেতৃত্বও তোমাকে নিতে হবে। জানি জঙ্গী নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই তোমার, কিন্তু তোমার বুদ্ধিমত্তা অজেয়-বিরল। লোকদের আবেগে তুমি ঘৃতাহুতি দিতে পার। এমন যোগ্যতা আর কারা মাকে দেখছি না আমি। তুমি না হয় একবার টলেডো ঘুরে এসো। ওখানে এলোগেইছ কিংবা ইলিয়ার কারো না কারো সাথে দেখা হবে।
কিছুক্ষণ আগে শুনতে পেয়েছি, আবদুর রহমান বিজয়োৎসবে গলা অবধি ডুবে গেছেন। সুলতানা আজ তাকে নয়া শরাব দিয়েছেন। স্পেন শাসক বিলাসিতার রসিক কিন্তু শরাব পান করেন না। আমি শুনেছি মোদাচ্ছে নারী তার এক স্ত্রী রয়েছে, সে তাকে মুঠোয় পুরেছে। সুলতান শবতের মধ্যে আজ পাব মিশ্রণ করে দেবে।
ওই শাসককে নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা যত তার সালারদের নিয়ে। এসব সালারদের সামনে স্বর্ণবাপ ফেলতে হবে। ফ্লোরার মত নারীদের পেশ করতে হবে। তথাপিও দেখবেন ওরা পাথরের মূর্তি। ওরা বড্ড স্বাধীনচেতা। স্পেনের সিংহশাসক। স্বাধীনতাকে ঈমানের অংশ মনে করে।
কিন্তু এই সালারদের মাঝে ক্ষমতার লোভ পয়দা করতে পারলে দেখবে ওদের সেনাবল নষ্ট হয়ে যাবে। সালার ক্ষমতায় এলে বাদশাহ হয়ে যায়। এবং দুশমনকেও দোস্ত ভাবা শুরু করে। ফলে এদের কোনো ধর্ম থাকে না। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের মাঝে ক্ষমতার বাসনা পয়দা করে দাও। ওরা একে অপরের রক্তলোলুপ হয়ে উঠবে। ফলে জাতি ক্ষুধার্ত থাকবে চারিত্রিক অবক্ষয় দেখা দেবে, প্রতাপে ভাটা পড়বে।
এদিকেও একটু খেয়াল করবেন। টলেডোর পরিস্থিতি উত্তপ্ত রাখতে হবে। এবার এ তরুণীকে সামলান। আমি যাচ্ছি। বলে হাশেম বেরিয়ে গেল।
***
ফ্লোরাও প্রতিবেশীর ঘরের সকলে বিমর্ষ, পেরেশান। ফ্লোরা নেই। নেই বৃদ্ধের জোয়ান পুত্রও। পুরুষ হওয়ায় বৃদ্ধ ভাবলেন তার ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু ফ্লোরা তো মেয়ে। সে বদ্ধঘরের জানালা পথে পালিয়েছে। সে পথে পালানো খুব সহজ নয়।
জোরার জোয়ান প্রতিবেশী বাড়ীতে এলো। জিন্দা নয়; মুর্দা হয়ে। লোকালয়ের উপকণ্ঠে ঘেরাবিষ্ক তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। স্বপিন্ডে তার আঘাত। ফ্লোরা যে তার হতা, ও সন্দেহটুকু কারো হয়নি।
ফ্লোরার বাবা এলেন। বদর তাকে বোনের যাবতীয় কাহিনী ও খ্রীস্টান হবার কথা জানান। ফ্লোরার মাকে বাবা বললেন, ওর অন্তর্ধানে তোমার হাত রয়েছে অবশ্যই। তুমি মোয়াল্লেদ হয়েছে বলে আমার ধারণা। বিগত ২০ বছর ধরে আমাকে ধোঁকা দিয়ে আসছ।
না’ জোড় হাত করে স্ত্রী স্বামীর পদতলে লুটিয়ে পড়লেন, আমাকে অপবাদ দেবেন না। আমি আপনাকে ধোঁকা দেইনি। নিজ হাতে আমাকে হত্যা করুন তবুও আমার প্রেমের প্রতি সন্দিহান হবেন না। খুব সম্ভব খ্রীষ্টান মেয়েদের সাথে মিশে ওর এই দশা। ওরাই ওর দেমাগ খারাপ করে দিয়েছে। বদর ওর ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে- পালাবার কারণ এও হতে পারে। পানিতে ডুবে মল কি-না কে জানে।
আমি ফ্লোরাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি। আমার অপর দুসন্তানের চেয়েও কেমন যেন ভিন্ন ধাতুর। কখনও নামায় পড়তে দেখেনি। তিনি খানিক চিন্তা করে বললেন, আমি এক গোয়েন্দা। বুঝতে বাকী নেই, কোখা গেছে ও। সিংহশাবক
তিনি পুত্রকে সঙ্গে করে বেরিয়ে গেলেন। চাপলেন বাপ-বেটা পৃথক দুটি ঘোড়ায়। সাথে নিলেন জনাচারেক সৈনিক। গিয়ে উঠলেন একটি গীর্জায়। ওখানকার পাত্রীকে বললেন, রাতে জনৈকা তরুণী তোমার এখানে এসেছে। তাকে তাড়াতাড়ি বের করে দাও।
আপনি গীর্জা ও আমার বসত-বাড়ী তল্লাশি করে দেখতে পারেন। পাদ্রী অনুনয় করে বললেন,
তরুণীর সাথে আমার সম্পর্ক কিসের?
সৈনিকরা এই পাদ্রীকে গ্রেফতার করল। গেল আরেকটি গীর্জায়। এই গীর্জায় পাদ্রীও পূর্বের পাদ্রীর মত অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
আমরা জানি গীর্জাগুলো আজকাল যড়যন্ত্রের আখড়ায় পরিণত। ফ্লোরার বাবা বললেন, একে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলো।
সৈনিকরা তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। প্রথম পাদ্রীও এদের সাথে। এদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে আচমকা একটি নারীকণ্ঠ সকলকে হতবাক করে দিল, আমার ধর্মগুরুদের ছেড়ে দাও। আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলো।
কণ্ঠটি ফ্লোরার। সে বলে চলেছে, আমি তাদের অপমান সইতে পারি না। তাই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছি।
বদর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মেরে আধামরা করে ফেলল, কিন্তু সে কাঁদল না, চিৎকার দিল না, কাউকে সাহায্যও করতে বলল না। বলছিল, আমি খ্রীস্টান। কুমারী মরিয়মের দাসী। এমন কি ইসলামের নামে যাচ্ছেতাই গাল দিল।