উভয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল শিকারী বিড়ালের মত লঘুপায়ে।
*
যুবক নেহায়েত সতর্কতা অবলম্বনপূর্বক দরজা খুলল। তার বুড়ো বাবা ও যুবতী স্ত্রী টের পেল না। সে আগে চুলল, ফ্লোরা পেছনে। তার বাড়ী থেকে দূরে এসে দাঁড়াল। এই এলাকাটি অনাবাদী।
কোথায় যাবে? ফ্লোরাকে প্রশ্ন করল।
ও দিক।
সেদিক তারা চলতে লাগল। ফ্লোরা তার অজান্তে ছোরা বের করল। আগ বাড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। যুবক পেছনে ফিরতেই তার বুকে ছোরাটা আমূল ঢুকিয়ে দিল। ছোরাটা একটা ঢুকে গেল যে, ওটা বের করতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হল। যুবক সামান্য আওয়াজ করারও সুযোগ পেল না। ফ্লোরার দিকে একবার বড় চোখ করে তাকিয়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ল এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি ………ঘৃণা ………. শুধু ঘৃণা। মুবকের রক্ত জামায় মুছে হন হন করে ছুটতে লাগল।
***
গভীর রাতে ও স্পেন শাসক মহলে এসে পৌঁছাল। এদিকে তখন মহলে আলোকসজ্জা যা জমকালো রাতকে দিনে পরিণত করছিল। সর্বাগ্রে তিনচারজন কবি আবদুর রহমানের শানে চাটুকারিতামূলক কাব্যচর্চা করছিল। তাদের জমজমাট কাব্যে স্পেন শাসক দিগ্বিজয়ী বিশ্ব বিজেতা হিসেবে চিহ্নিত। তার তলোয়ারকে শেরে খোদার তলোয়ারের সাথে তুলনা কলেন। তাদের কাব্যের ভাষ্যে আবদুর রহমান ইহুদী নাসারাদের জন্য যমদূত। তার সামনে মাথা ওঠালে সে মাথা আর আস্ত থাকে না। তুমি মূর্তি হলে আমরা তোমাকে পূজা করতাম।
পরে সারিবদ্ধ খোশামোদীরা তাকে তোহফা পেশ করতে লাগল। দিতে লাগল চুমো, এ থেকে তার জুতোও বাদ যায় না। এরপর অর্ধনগ্ন নৃত্যশিল্পী নেচে গেয়ে তার মনোরঞ্জন করতে চেষ্টা করে। এদের সংগীত পরিচালক যিরাব।
আবদুর রহমানের ডান পার্শ্বে সুলতানা আর বামপার্থে মোদাচ্ছেরা। অন্যান্য বিবি ও বাদীরা পেছনে। বিজয়োৎসবের এই আসরে সমস্ত মালার স্বয়ং উপস্থিত। তারা শাসককে দেখছিলেন। তাদের ধারণা, এ আরেক আবদুর রহমান।
এ লোককে আমরা অভিযানে ব্যস্ত রাখতে চাই। বললেন আবদুর রউফ সালারদের।
তার কাছে জৌলুস ও ইন্দ্রীয়পরায়ণতার এত উপকরণ ভালো নয়।
উবায়দুল্লাহ বললেন,
চাটুকার কবির্গ শব্দের জাদুতে তাকে মোহিত করে চলেছে এবং ইসলামের শেকড় কাটছে। আমাদের দুশমন আড়মোড়া দিয়ে জাগছে। এগুলো বিষ, যা তিনি গিলে চলেছেন।
আমার যদ্দুর ধারণা, টলেডোর খ্রীস্টানরা জেগে উঠবে।
মূসা বললেন, বিদ্রোহের এই পরম্পরা উৎখাত করে যাব আমরা।
পন্থা এর একটাই- ফ্রান্সে হামলা, সম্রাট লুই এর-মস্তকচুর্ণ। এই লোক স্পেনের খ্রীস্টানদের মদদ দিয়ে চলেছে। সে স্পেনকে খণ্ডবিখণ্ড করতে চায়। বিদ্রোহীদের এক স্থানে কচুকাটা করলে অপরস্থানে ওরা মাথা তুলে দাঁড়ায়।
***
যখন স্পেন শাসক নৃত্য শিল্পীদের যৌন উন্মাতাল দেহের ভাজে ডুবে ছিলেন, যখন তার ভেতরের পৌরুষত্ব খাবি খাচ্ছিল তখন হাশেম কর্মকারের দরজায় করাঘাত পড়ল।. হাশেমের দেহে এক্ষণে আর সেই দম নেই, ফ্লোরার মা প্রথমদিকে আসায় যা ছিল। তখন ফ্লোরা তার মায়ের পেটে। ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। এক্ষণে তার চেহারায় যৌবনের ইতিহাস। ৫৫/৬০-এর মাঝামাঝি বয়স ছিল, দিল-দেমাগ অবশ্যই আগের চেয়েও তুখোড়। তার গুপ্ত দলের শেকড় বেশ বিস্তার লাভ করছে। মাদ্রিদের বিদ্রোহ দমন করা হলে তিনি অন্য কোথাও বিদ্রোহ করার পাঁয়তারা করছিলেন। তার এবারের দৃষ্টি টলেডো।
দরজায় করাঘত হলে তিনি চমকে ওঠেন। ড্রয়ারে লুকানো ছোরা নিয়ে বের হন এবং দরজা খোলেন। জনৈক তরুণীকে দেখে তার আক্কেল গুম।
আমি ফ্লোরা। বলে ফ্লোরা ফওরান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, জনৈক মুসলিম প্রতিবেশীকে হ্যাঁ করে এসেছি। এসেছি বাড়ী থেকে পালিয়ে। বলো এখন কি করব? হাশেমকে সে পুরো ঘটনা জানিয়ে গেল।
ফ্লোরা ইতিপূর্বে বেশ কবারহাশেমের কাছে এসেছে। হাশেমও তাকে ইসলামের বিরুদ্ধে উকে দিয়েছে। প্রেম নিয়ে তার কোনো উচ্চাভিলাস নেই। তার প্রেম খ্রীস্টরে মাঝে, এর জন্যে সে পাগলপারা।
হাশেম বলল, আমি তোমাকে আমার কাছে রাখব না। সকাল হতেই এখানে লোকজনের আনাগোনা শুরু হবে। তোমাকে জনৈক পাদ্রীর কাছে নিয়ে যাব।
পীর দরজায় করাঘাত পড়তে তিনিও চমকে ওঠেন। কে আসতে পারে এখন? মাদ্রিদ বিদ্রোহে পত্রী-গ্রেফতারের হিড়িক পড়লে এদের সকলে ভয়ার্ত ছিলেন। কিন্তু দরজা খুললে প্রাণে পানি এলো। দেখলেন জনৈক সুন্দর যুবক ও বৃদ্ধ একলোক। যুবক ভেতরে ঢুকে আচকান ও ছদ্মবেশ খুলে ফেলল। হাশেম বলল,
ও ফ্লোরা। ওর সম্পর্কেই আপনাকে ইতিপূর্বে অবহিত করেছি। ওর মা আপনার সাথে বেশ কবার সাক্ষাৎ করেছেন। মেয়েটা আজ ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে। হাশেম পুরো ঘটনা তাকে শুনিয়ে গেলেন।
বৃদ্ধ পাদ্রী ফ্লোরার রূপে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
তুমি খুবই সুন্দরী ফ্লোরা। স্পেন শাসকদের শেষ করতে তোমার এ রূপ কাজে লাগবে। তুমি সালারদের মাঝে দ্বন্দ্ব লাগাতে পার। তোমার এক চিলতে মুচকি হাসি মুসলিম সালারদের রণাঙ্গনে আমাদের কয়েদী বানাতে পারে। বর্তমান স্পেন শাসক তোমার মতো তাক লাগানো সুন্দরী পেলে হৃদয় থেকে স্পেনকে মুছে দিতে পারে এটাই তার দুর্বলতম দিক। তুমি তাকে ও তার সালারদের মাঝে ঘৃণা সৃষ্টি করতে পার, কিন্তু এর জন্য তোমাকে……।