কিন্তু তিনি আমাকে দেখলেন কবে? শুনেছি জনাতিনেক পরমা সুন্দরী হেরেমে আটকা। আরও শুনেছি তিনি একজন পাক্কা মুসলমান ও দরবেশ প্রকৃতির যুদ্ধংদেহী। খুব সহব এজন্যই বুঝি তার কাছে আমার নামোচ্চারিত হয়নি আজো; সুলতানা বললেন। সুলতানার কণ্ঠে আকুতি ও খায়েশের সুর।
ইতিহাস বলছে, রাণী হওয়ার পাগলামি তার চেপে বসেছিল। রাণী হওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রচণ্ড আশাবাদীও ছিলেন। এজন্য অন্য কোন পুরুষের প্রেম নিবেদনে সাড়া দেননি কোনদিনও। এছাড়া প্রতারণায়ও তার বিশেষ খ্যাতি ছিল। তিনি দরবেশকে বললেন,
আমি রাণী হতে চাই-একথা বলা ছাড়াই রাণী হওয়ার ব্যাপারে তুমি আমাকে। কোনরূপ মদদ করতে পার না? পার না আমাকে ময়ূর সিংহাসনে পৌঁছে দিতে? শুনেছি দরবেশরা অনেক কিছুই করতে পারে।
এর পূর্বে বলল, তুমি কোন মুসলিম শাসকের রাণী হতে চাও কি………
সুলতানা হেসে বললেন, আমার চাহিদা ধর্মীয় দৃষ্টিতে নয়। ধার্মিক হলে এতদিনে আমি অন্য কারো স্ত্রীত্বে থেকে বাচ্চা-কাচ্চার মা হতাম।
তাহলে আমি যা বলব সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবে কি? একটি প্রদেশ তোমার অপেক্ষায়- যেটা মুসলমানদের হতে পারে না। তোমাকে দ্বিতীয় আবদুর রহমানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে এবং তার হেরেমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হতে হবে।
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে তাকে বাধ্য করবো আমাকে রাণী করতে-এইতো? না। সে তোমাকে রাণী নয় বিবি বানাবে। পরে একদিন তোমার ওপর বিরাগী হয়ে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। পরবর্তীতে তোমার মত কাউকে নির্বাচিত করে নেবে। তার চেয়ে শোন, এই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে পার। করলে তুমি ওই প্রদেশের রাণী হতে পারবে। তোমার হাতে থাকবে বিশাল ফৌজ ও স্বাধীন রাজত্ব।
সুলতানা অসাধারণ বুদ্ধিমতী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্না নারী ছিলেন। তিনি দরবেশের কথা খুবই ধীরস্থির মস্তিষ্কে শুনে যাচ্ছিলেন। বারকয়েক দেখে নিয়েছিলেন তার চেহারাও। আচমকা তিনি উঠে দাঁড়ালেন। অগ্রসর হয়ে দরবেশের দাড়ি ধরে আঁকা দিলেন। দাড়ি তার হাতে উঠে এল। অপর হাত দরবেশের মাথায় রেখে হ্যাঁচকা টান মারলে মাথার চুলও তার হাতে লেগে থাকল। মুখের থেকে নকল দাড়ি ও মাথা থেকে নকল চুল অপসারিত করে সুলতানা দেখলেন, কোথায় কার দরবেশ! এতো এক জোয়ান আদমি।
কে তুমি? গোৰা, বিস্ময়ে হতবাক কণ্ঠে বলেন সুলতানা, কি জন্যে এসেছে এখানে? তোমার কি জানা নেই যে, আমি তোমার লাশ কুত্তা দিয়ে খাওয়াতে পারি?
তাগড়া জোয়ানটি ভয়ে না কেঁপে মুচকি হাসতে লাগল।
এলোগেইছ আমার নাম রাণী! ছদ্মবেশে তোমার কাছে আসা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তুমি আমার লাশ কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে- এ মানসিকতা নিয়েও আমি আসিনি। আমার ছদ্মবেশ উন্মোচিত হবার পরও ঐকথা বলবো- ছদ্মবেশী থাকতে যা বলেছিলাম। কথার মাঝে ধর্ম এজন্য টেনেছি যাতে তোমার ইসলাম প্রিয়তা প্রবল হলে ওভাবেই ফিরে যেতে পারি।
তুমি কি আমায় খ্রীস্টান বানাতে এসেছ? প্রশ্ন সুলতানার।
না সুলতানা, তুমি মুসলমান থাকছ এবং রাণী হবার পরও থাকবে। বলে এলোগেইছ পকেট হাতড়ে একগোছা মোতির মালা বের করলেন। কুপির টিমটিমে আলোতে তা চকচক করে ওঠল। তিনি আরো বললেন, এটা কেবল রাণীদেরই সোনার অংগে শোভা পায়।
মোতির মালা তিনি সুলতানার দিকে বাড়িয়ে বললেন, এটা তোহফা। জানো, কে প্রেরণ করেছে? ফ্রান্স সম্রাট লুই। নাও, তোমার এটা।
সুলতানার চোখে বিস্ময়। তিনি আনন্দে উহ্। সত্যিই এ ধরনের মালা তার জীবনে প্রথম। তারপরও তা ফ্রান্স সম্রাট প্রেরিত। বিস্ময়ের ঘোর কেটে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কি চান ফ্রান্স সম্রাট? প্রশ্নের ঢং কতকটা এমন যেন তিনি নিজকে ভুবন মোহিনী ভাবছেন এবং সম্রাট তার নারী সুষমার স্বাদ নিতে পাগলপারা।
তিনি তোমাকে সম্রাজ্ঞী বানাতে চাচ্ছেন না, চাচ্ছেন একটি প্রদেশ দিতে। প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা দেয়া হবে না তোমাকে বরং তোমাকেই প্রতারণায় প্রতিভূ হতে হবে।
তার মানে দ্বিতীয় আবদুর রহমানের প্রাসাদে প্রবেশ করিয়ে আমার দ্বারা তাকে ধোকা দেয়া হবে এই তো। তোমার দুঃসাহসিকতার তারিফ করি আমার গ্রেফতানীর শংকা তোমার মাঝে নেই দেখে। আমি তোমায় হত্যাও তো করতে পারি।
তুমি জিন্দা থাকলে তো? আমার যবান এক কিন্তু শক্তিৰাহু ও হাত অনেক। আমি একাকী নই। এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য আমাকে ছায়ার ন্যায় ঘিরে আছে। যতটা আমি যমীনের ওপরে ঠিক ততটা অভ্যন্তরেও আমাকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা ত্যাগ কর সুলতানা। আমি তোমার ভবিষ্যৎ চমকে দেব। তোমার ভুবন মোহিনী সৌন্দর্য থেকে ফায়দা তোল। তোমার ওই রূপ-যৌবন ক্ষণিকের তরে। তোমার থেকে কিছু নিতে নয় দিতে এসেছি আমরা। আবদুর রহমান তোমাকে নয়নমণি বানাবে। তাঁকে দিওয়ানা বানিয়েই তোমার স্বার্থোদ্ধার করতে হবে।
এমনিতেই আমি একাকী। প্রাসাদে যাবো ভাবলে তুমি ভুল করছ। একাকী যাঞ্চা করে গেলে আমার মূল্যায়ন হবে না।
তার চোখে তোমার রূপের ঝলক ফোঁটানোর দায়িত্ব না হয় আমিই নিলাম। তুমি স্রেফ বলো, আমাদের প্রস্তাবে সম্মত কি-না। বাকী কাজ আমরাই করব।
কি করতে হবে আমাকে?
আবদুর রহমানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে, রূপের হাটের সওদাগর বানাতে হবে। তিনি তার তিন বাদীর জন্য পাগল। ওদেরকে সতীন জ্ঞান না করে ওদের সাথে মিলে আবদুর রহমানের সত্তাকে নারীত্বের মাঝে লীন করে দেবে। যেনতেন মানুষ নয় সে। নারীমোহ হোক একবার চোখ ফেরালে গোটা খ্রিস্ট বিশ্বে তার প্রভাব পড়বে। তাঁকে পাগলপারা করে তোল, বিষ প্রয়োগ কিংবা হত্যা নয়। বিনিময়ে যা পাবে তা তোমার স্বপ্নাতীত ও কল্পনাতীত।