বাড়ীর পথ ধরার সময় যুবতী অনুমান করলেন, লোকটা স্রেফ কর্মকারই নন তার ব্যক্তিত্বে রয়েছে আকর্ষণ– সাধারণ মানুষের বেলায় এমনটা দেখা যায় না।
***
ইতিহাস নীরব থাকেনি। এগিয়ে চলেছে তার গতিপথে। ইতিহাসের বাঁকে তাই দেখা যায় হাশেমের আলোচনা। তিনি সত্যিই ছিলেন চৌকস, ছিলেন মোয়াল্লেদ। মুসলমানদের অমানবিক আচরণ নও মুসলিমদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ঘোড়ার লৌহজুতো বানাতে মানুষ তার কাছে আসত। তম্মধ্যে খ্রীস্টান-মুসলিম উভয়ই ছিল। তিনি খ্রীস্টানদের মন জয় করতে চেষ্টা করেন। অতি গোপনে তিনি খ্রীষ্টান পুনর্জাগরণ বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি সকলকে ফ্লোরার বাপ থেকে সতর্ক করেন। বলেন, রহস্যভেদী এ টিকটিকি থেকে সাবধান।
ফ্লোরার মা তার কাছে যাতায়াত করে থাকেন। পীরের আসনে বসান তাকে। তিনি হাশেমকে মনের খবরটা দিয়ে বলেন, কিছুতেই ইসলামকে মনে ঠাই দিতে পারছি না। আরো বলেন,
আমার স্বপ্ন নিছক স্বপ্নই নয়। সত্যিই এটি এক প্রাঞ্জল দিক নির্দেশনা।
হা! এটা নির্দেশনা। তবে স্বামীকে ইসলাম বৈরিতার ব্যাপারটা বুঝতে দিও না। পরবর্তীতে হাশেম তাকে বলেন, তুমি এখনো স্বামীকে উপেক্ষা করতে পার না। উপেক্ষা করলে মারা পড়বে।
স্বামীহীনা হতে চাই না। এ লোকটার সাথে আমার প্রেম ততটুকু যতটুকু খ্রীস্টত্বের সাথে। তার ছায়াতলে থেকেই খ্রীস্টত্বের মুক্তির জন্য সম্ভব সব কিছু করব, নয়ত আমি পাগল হয়ে যাব।
তুমি সন্তানের মা হতে চলেছ। ছেলে হোক মেয়ে হোক তাকে বাবার অজান্তে খ্রীস্টত্বের তালিকা দিও। তার হৃদয়ে মুসলিম বিদ্বেষ পয়দা করো এবং সে অবস্থায় ছেড়ে দিও। পরবর্তী সন্তানের বেলায় এই ঝুঁকি নিতে যেও না। কেননা তার বাবা জেনে যাবে। সে অবস্থায় তোমার পরিণতি খারাপ হয়ে যাবে। যে সন্তানকে তুমি খ্রীস্টান বানাবে নিজের ভবিষ্যৎ সে নিজেই গড়ে নেবে এবং তোমার আত্মার প্রশান্তি আনবে। খ্রীস্ট ধর্মের জন্য তুমি একটা কাজ করতে পার। তোমার স্বামী সরকারী গোয়েন্দা। তুমি তার প্রাইভেট সেক্রেটারী হয়ে ভেতরের খবরাখবর সংগ্রহ করে। তার কাছে অনবরত জানতে থাকবে, খ্রীস্ট ধর্মের বিরুদ্ধে তার প্রোগ্রাম কি। এতে পরিবর্তন আসছে কি-না? যদি আমাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ দেখ তৎক্ষণাৎ আমাদের অবহিত করো।
হাশেমের এই কথায় যুবতীর আত্মিক প্রশান্তি আসে। রহস্যভেদী তার যে স্বামীর চোখ ভূগর্ভের ষড়যন্ত্রও উদ্ধার করতে পারত, প্রেমের আড়ালে তার স্ত্রী যে ইসলাম উ স্থাতের ষড়যন্ত্র করছে, ঘূর্ণাক্ষরেও তা জানতে পারল না।
***
ফ্লোরা ভূমিষ্ঠ হলো। বাবার রাখা নাম সম্পর্কে ইতিহাস নিশুপ। ফ্লোরার একটু বুঝসুঝ হলে মা তাকে শিক্ষা দিলেন, সত্য চিরন্তন ধর্ম সেতো খ্রীস্টান ধর্ম। ইসলাম কোনো ধর্মই নয়। ফ্লোরার বয়স এক বছর হলে তার একটি ভাই জন্ম নেয়। বছর দুয়েক পরে ওদের আরেকটি বোন হয়। ভায়ের নাম বদর। সে তার বাবার মত হয়। মার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকত ফ্লোরার ওপর।
১৩/১৪ বছর বয়সে ইসলামের প্রতি ফ্লোরার ঘৃণা এত চরমে পৌঁছে যে, সে তার বাবাকে বাবা ও ভাইকে ভাই ডাকা পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। মা তাকে মজলুম খ্রীস্টানদের কাহিনী শোনাতেন, মুসলমানদের তিনি জালিম হিসেবে চিহ্নিত করতেন। মেয়েকে সে সব স্বপ্নের কথাও শোনাতেন যেগুলো তিনি বিয়ের প্রথম দিকে দেখে থাকতেন। ফ্লোরাকে কখনও বাইরে যেতে দিনে না। ও কোনো তথ্য ফাঁস করে দেয় কি-না ভয় কেবল এটাই। আশপাশের লোকেরা অকে মুসলিম ঘরানার সন্তান বলেই মনে করত।
সেই ফ্লোরার বয়স যখন ১৮ তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে স্পেন শাসক আবদুর রহমানের বিজয় কাফেলা অবলোকন করছিল। তার চেহারা ক্রমশ কুঁচকে যাচ্ছিল ঘৃণায়। মা তাকে বললেন, ফৌজের চলার পথে ফুল ছিটিয়ে দাও, হ্যান্ডশেক করো। তোমার বারা নীচে কোথাও আছেন। তিনি এ.অবজ্ঞার কথা জানলে কিয়ামত কায়েম, করবেন। ফোরা মায়ের কথায় ক্ষেপে গিয়ে বলল, আমি কি ঐ দুশমন জাতির চলার পথে ফুল ছিটাব যারা মাদ্রিদের অলিগলিতে খ্রীস্টানদের রক্তে প্লাবিত করেছে? মা তাকে বললেন, রাগ সংবরণ করো মা! কিন্তু নিজের হাতে যে আগুন তিনি জ্বেলেছেন, তা নেভার নয়। যে ঘৃণা হৃদয়ে তিনি পয়দা করেছেন তা কভু মিটে যাবার নয়।
মা ফ্লোরা জানালার কপাট বন্ধ করে বলল, আমি এখন আর এ ঘরে থাকতে পারি না।
আরে বেকুফ নাকি! কোথায় যাবে তুমি?
কোনো গীর্জায় আশ্রয় নেব। যদি থাকি এখানে.তাহলে বাবা-ভাইকে হত্যা করেই।
মেয়ের মুখে সজোরে চপেটাঘাত করে মা বললেন, বাবা-ভাইকে হত্যা করার জন্যই কি তোকে আমি খ্রীস্ট শিখিয়েছি?
হ্যাঁ হ্যাঁ, ফ্লোরা চিৎকার দিয়ে বলল, এই শিক্ষাই তুমি আমার দিয়েছ যে, মুসলিম জাতি হিংস্র, বর্বর। ওরা খ্রীস্টের দুশমন।
মায়ের চোখে পানি এসে গেল। নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত অনুভব হলো তার। তিনি মেয়েকে মেহার্ভ কণ্ঠে বললেন, খ্রীস্টান ছেলের সাথে বিবাহ দেয়ার জন্যই তোমাকে খ্রীস্টত্ব শিক্ষা দিয়েছি। আমার রক্তের একটা ধারাকে খ্রীষ্টত্বের সাথে মিলাতেই তোমাকে খ্রন বানিয়েছি। আর তুমি কি-মা তোমার বাবাকে আমায় তালাক দেয়ার পথ সুগম করছে।
আমি খ্রীস্টান মা! শুধুই খ্রীস্টান। এটা মুসলমানদের ঘর। এ ঘরের প্রতি আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা। কামরায় একটি বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল, কি কি বললে তুমি? তুমি খ্রীস্টান?