এক সময় খুলে যায় চোখ। হাত তখনও বক্ষদেশে ঘুরে ফিরছে। ওখানে এক্ষণে কুশ নেই। মনে পড়ে মাসচারেক আগে উদ্ধারকালে তার এই উদ্ধারকর্তা ক্রুশ গলার থেকে ছিনিয়ে পদতলে পিষ্ট করছিল। কুশ অপমানের জ্বালায় তিনি পুড়ে মরেন। সেই স্বামী আজ তার পাশে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এই লোক যদি তাকে জোরপূর্বক বিবাহ করত তাহলে নির্ঘাত হত্যা করে বসতেন তিনি। পরে কোনো গীর্জায় নাব্রত পালন করতেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অঙ্গুলি হেলনের শক্তি-সুযোগ নেই যে।
হাত দুটি তখনও বক্ষদেশে। অন্ধকার আকাশে স্বপ্নে দেখা সেই বর্ণ এখনও বিদ্যমান। কামরায় গরিলার আওয়াজের প্রতিধ্বনি ভাসছে। এক সময় তর্জনী আঙ্গুল দ্বারা বুকে ক্রুশ আঁকেন। এতে মনে সান্ত্বনা আসে।
এখান থেকেই তার প্রেমে বিভাজন আসে। এর সপ্তাহ খানেক পরে তিনি স্বপ্নে যেন কার ডাক শুনতে পান, তুমি খ্রীস্টের পূজারিণী–মুসলিম নও। আবার দেখেন, আগুন জ্বলছে, মানুষ পুড়ছে। চাঁদের আলোয় ছোট ছোট হাজারো ক্রুশ বাতাসে ভেসে চিকচিক করছে। মুসলিম সৈনিকরা এগুলো নামিয়ে পিষ্ট করছে। তিনি সৈনিকদের বারণ করেন, কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় না। ভাঙ্গা কুশ হাতড়ান, পান না। শেষ পর্যন্ত বুকে হাত দিয়েই ক্রুশ অঙ্কন করে মনকে প্রবোধ দেন।
স্বপ্নে তিনি এখন আর ভয় পান না। স্বামীর সেই বৃত্তান্ত মন থেকে বের করে দেন। স্বপ্ন দেখার পর অনপোলব্ধিগতভাবে নিজে একটা বৃত্তান্ত করতেন। স্বপ্নের তাবীর বুঝতেন, তিনি খ্রীস্টানের ওপর দৃঢ় থাকার নির্দেশ পাচ্ছেন। যে নির্দেশ পাচ্ছেন তা তাকে শুনতে হবে, বুঝতে হবে।
স্বপ্নে নির্দেশাবলীকে তিনি গ্রহণযোগ্য ও সত্যি বলে মেনে নেয়ার পর তার হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। এদিকে স্বামী তার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকাল তিনি সব কিছু ভুলে যান। আপনার সত্তা, ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য সবকিছু স্বামী সত্তার মাঝে লীন করে দেন। প্রেম এমন এক মহৌষধ যাতে স্বামীর অঙ্গ বনে যান স্ত্রী। অঙ্গাঙ্গি এই সম্পর্ক মানুষকে সব কিছু ত্যাগ করতে তালিম দেয়। ব্যাপারটা ফ্লোরার মাকেও উদগ্রীব করে। উপলব্ধিগতভাবে তিনি এই দ্বি-চারী মনোভাব সমর্থন করতেন না। তবে সচেতনভাবেই ধর্মের টানটা কেন যেন তার মাঝে এসেই যেত। শরীরের রক্ত যেন খ্রীস্টত্বই জপত তার মাঝে।
***
তার স্বামী গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা। দায়িত্ব পালনে তাকে বাড়ীর বাইরে থাকতে হত। তার উপস্থিতিতে স্ত্রী নামায আদায় করতেন, তার থেকে কোরআনের সবক নিতেন, কিন্তু তিনি ঘরের বাইরে গেলে খ্রীস্টের উপাসনা শুরু করতেন। বাড়ীর নিকটেই একটি গীর্জা ছিল। এর থেকে ঘন্টাধ্বনি আসত। তিনি ঘন্টার আওয়াজ শুনেই ওখানে হাজির হতেন।
স্বামীর ছিল দুটি ঘোড়া। একটি অনেক আগের আরেকটি ছিনতাইকারীদের থেকে নেয়া। এই ঘোড়া ছিল তার সুবর্ণ বাহন।
একদিন বাড়ী থেকে বের হবার সময় স্বামী তাকে বললেন, ঘোড়ার পায়ে লোহার কড়া (জুতো) পরানো দরকার। বিশেষ কাজে আমি কর্ডোভার বাইরে যাচ্ছি। বাইরের থেকে তুমি জুতা লাগিয়ে নিও। তিনি বাড়ী ছাড়ার পর স্ত্রী ঘোড়ায় চেপে জুতো লাগানোর তালাশে বের হলেন। কেউ তাকে বলেছিল, হাশেম কর্মকার ভালো জুতো বানাতে পারে, সে বর্শার বেয়নেট বানায়, বানায় তলোয়ার, খঞ্জর ও তেগও। মাঝবয়সী সাধারণ গোছের এই কর্মকার। ছোটখাট সংসার। শহরের মানুষ তাকে এক নামেই চেনে।
১৮ বছরের নজরকাড়া সুন্দরীর আগমনী দেখে হাশেম তার নিটোল গালের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। যুবতীর দুঠোঁটে মুচকি হাসি। সেই হাসির ছটা মুখে রেখেই তিনি প্রশ্ন করেন-খ্রীস্টান বুঝি?
যুবতী সহসাই উত্তর দেয়, না।
তাহলে নও মুসলিম?
হ্যাঁ, মুচকি হেসে হাশেম বলেন, এখানে কি উদ্দেশ্যে?
হাশেম কাজ ছেড়ে বাইরে আসেন এবং ঘোড়র জুতো খুলতে থাকেন। কাজ করার পাশাপাশি যুবতীর সাথে তিনি কথা চালিয়ে যান। যুবতী অবাক নয়নে লক্ষ্য করেন, লোকটার কাজের চেয়ে মুখ চলছে বেশী। সামান্য আলোচনার পর তিনি ধারণা করেন লোকটার খপ্পরে পড়ছেন তিনি। চির পরিচিত মানুষের মত অকৃত্রিম আলাপচারিতা শুরু হয়। যুবতীর দোদুল্যমান মনোব তাকে এই আলাপে আরো আগ্রহী করে তোলে। স্বামী ও ধর্মের দোদুল্যমানতা প্রকাশের একটা অভয়ারণ্য মনে করেন এই কর্মকার। এক পর্যায়ে তিনি বলে ফেলতে চান মনঃকষ্টের কথা। স্বামী ও খ্রীস্টধর্মের দ্বন্দ্ব সংঘাতের কথা। কিন্তু হাশেমকে মুসলমান জানতে পেরে নিজকে সংযত করে নেন।
১৮ বছর পর্যন্তু খ্রীস্টান থাকলে, কি বুঝে সংঘাতধর্মী একটি ধর্ম গ্রহণ করলে? কেন করলে? প্রশ্ন হাশেমের।
কিছু একটা বুঝেই করেছি। কিন্তু ও প্রশ্ন কেন আপনার?
তোমার থেকে কোনো তথ্যোদ্ধার উদ্দেশ্যে নয় আমার। অভিজ্ঞতা আমার প্রচুর আমি ইতিপূর্বে খ্রীস্টান ছিলাম। একটি কারণে মুসলমান হয়ে যাই। সে বহু পুরনো কথা। মুসলমান হলেও হৃদয় থেকে খ্রীষ্টের শিক্ষা ভুলতে পারিনি। গভীর রাতে গীর্জার ঘন্টাধ্বনি আমার কানে গুঞ্জনে তোলে। তখন মনের কি অবস্থা হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই অনুমান করতে পারে।
আপনার এই অভিজ্ঞতার ভোজা আমিও একজন। এ রকম দোদুল্যমান রোগী আমি। সত্যিই, শত চেষ্টা করেও ধর্মীয় টান তনুমন থেকে মুছতে পারছি না।