তরুণী খানিক ভেবে বলল, হা হা। ধর্মান্তরিত হয়ে হলেও আপনার স্ত্রীত্বে বরণ করতে রাজি। আপনার মত মানুষই হয় না। আমার মত সুন্দরী বাগে পেয়েও যার এতটুকু আকর্ষণ নেই তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে।
আগন্তুক যুবতীর গলায় ক্রুশ ঝুলছে, তিনি কুশমালা হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেন। ক্রুশদণ্ড সামান্য তখনও তার হতে ছিল। ওটা যমীনে ফেলে পায়ের তলায় পিষলেন। বললেন, চলো আমার সাথে।
তিনি ছিনতাইকারীদের ঘোড়াগুলো কজা করলেন। একটিতে তরুণীকে চাপিয়ে অপর দুটির লাগাম হাতে নিয়ে কতলুয়ানার উদ্দেশ্যে চললেন। তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ছিল বেয়ে। আস্তে আস্তে হয়ে আসছিলেন নিস্তেজ। শহরে তার চিকিৎসা হয়। মাসখানেক পরে তরুণী মুসলমান হয়ে গেলে ওই অফিসারে সাথে তার বিবাহ হয়।
তরুণীটি ধর্মপ্রান খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের। চরম মুসিবতে নিজকে এই লোকের হাতে সোপর্দ করে বিবাহত্বে আসার পর নিজ ধর্মের টান হৃদয় থেকে মুছতে পারলেন না, আবার একে ছাড়তেও পারলেন না। এই লোক না থাকলে হয়ত তিনি বর্বরদের পাশবিক হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতেন।
একদিকে উদ্ধারকর্তার প্রেম অপরদিকে খ্রীস্টধর্মের টান। সর্বোপরি পরিবারের সকলের মৃত্যুশোক তিনি কি করে ভুলবেন। স্বামী তার সেই লোক-ই যিনি নিজে খ্রীস্টান বিদ্রোহীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করেছেন। তার পরিবারে মর্মান্তিক মৃত্যুর মূলে বহলাংশেই দায়ী তার স্বামী। তার মনে নেই কত সহস্র খ্রীস্টান অগ্নিকংকাল হয়েছে এবং কত নারী বাদী হয়েছে। তার এই স্বামী গলা থেকে ক্রুশমালা শুধু ছিঁড়েই ক্ষ্যান্ত হননি, পায়ের তলে পিষেছেনও। কুশদণ্ড তিনি চোখের ওপর রেখেছেন চিরদিন- কিন্তু তিনি তা দিয়েছেন পায়ের তলে। মুসলিম স্বামীকে তিনি ধর্মান্তরকরণের কথা বলেছেন। বলেছেন তার প্রতি অগাধ আকর্ষণের কথাও, কিন্তু হৃদয়ের কোণে জমাট খ্রীস্টধর্মের যে অগাধ মমতা তা বলেননি, জানতেও দেননি কোনদিন।
***
অনেক চেষ্টা করার পরও মনে প্রাণে ইসলামকে গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। এক বছর পর তার কোলজুড়ে একটি কন্যা সন্তান আসে। বাবা তার নয়নের মণির সুন্দর নাম রেখেছিলেন। ইতিহাসে ওই নামটি অবশ্য সংরক্ষিত নেই। মা তাকে ফ্লোরা নামে ডাকেন। বাবা এতে আপত্তি জানান না। ফ্লোরা নামকেই মা চয়েজ করেন। ইতিহাসে সে এ নামেই খাতে।
ফ্লোরা সেই নাম যে বহু কাহিনীর জন্মদাতা। এই নামে অসংখ্য নাটক লেখা হয়েছে। সাহিত্যের পাতায় এই ফ্লোরার প্রেমে মুসলিম সেনাপতি ও শাহযাদাদের তড়পাতে দেখা যায়। কোনো সাহিত্যিক তাকে ক্লিওপেট্রা বলে খেতাব দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবের সাথে এসব নাটক-উপন্যাসের কোন মিল নেই। মুসলিম ইতিহাসবেত্তাদের পাশাপাশি অমুসলিম ইতিহাসবেত্তারা পর্যন্ত ফ্লোরারে মত ইসলাম বেরিতার প্রতিভূ ছিল। এই মেয়ের দ্বারাই স্পেন থেকে মুসলিম উৎখাতের প্রেরনার উৎস পেয়েছিল তাবৎ খ্রীস্টান শক্তি। ইসলাম বৈরিতার এই ষড়যন্ত্র-কন্যার মাধ্যমে খ্রীস্টান জাতি তাদের দলে অসংখ্য মানুষকে ভেড়ায়। এই আন্দোলনকে ইতিহাসে মোয়াল্লেদ (মুসলিম হটাও আন্দোলন) বলা হয়।
ফ্লোরার মা ছিল এই আন্দোলনের পুরোধা। দ্বীনদার এক মুসলিমের স্ত্রী, নামটাও ইসলামী। কিন্তু মনে প্রাণে কট্টর খ্রীস্টান। তাই তিনি ফ্লোরাকে আশৈশব খ্রীস্টত্ব শিক্ষা দিয়ে আসছেন। স্বামীর প্রতি অগাধ প্রেম থাকায় তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম ছাড়তে পারেননি। আবার খ্রীস্টত্বের ঘোষণাও দিতে পারেননি। মন থেকে বাপ-দাদার ধর্ম মুছে ফেলতে চেয়েছেন বারংবার, কিন্তু পারেন নি। কুশ তার শৈশবের খেলা ছিল, যৌবনের ছিল মাবুদ। ১৮ বত্সরের যুবতীর দেহ থেকে খ্রীস্টত্ব পড়ত টপকে টপকে।
এক মুসলিমের সাথে বিবাহ। এর থেকেই সন্তান। অবশ্য প্রতিপালন মুসলিম হিসেবে হয়নি। হয়েছে মনের কোণে লুকানো খ্রীস্টত্বেই। গর্ভে আসার পর ফ্লোরার মা একবার স্বপ্নে কি দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। স্বামী তাকে বুকে চেপে ধরে। বাচ্চাদের মত সান্ত্বনা দেন। কোরআনের আয়াত পড়ে ফুঁক দেন। নিজের গালে উভয় হাত রেখে বড় চোখ করে তাকিয়ে বলেন, আগুন লেগেছে আগুন! উঠে দেখ! কে যেন ঘরে আগুন লাগিয়েছে। মানুষ পোড়া গন্ধ তোমার কানে আসছে না? কে যেন জ্বলে ছাই হচ্ছে।
যখন তার পুরোপুরি হঁশ আসে তখন স্বামীর কোলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। স্বামী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, যুবতী মেয়েদের প্রথম সন্তান গর্ভে আসলে একটু আধটু এ রকম আছর হয়েই থাকে। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। স্বামী কাছে থাকলে এ ধরনের আছরে তেমন কোন ক্ষতি হয় না।
ফ্লোরার মা স্বামীর ওই বৃত্তান্তকে দুঃস্বপ্ন বলে মেনে নেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর স্বপ্নে গীর্জার ঘন্টাধ্বনি শুনতে পান। আওয়াজটা খুবই অস্বাভাবিক। বিলকুল গরিলার মত গর্জন। পরে এই আওয়াজ অগ্নিরূপ ধারণ করে দূর দরাজ পর্যন্ত তার শিখা ছড়িয়ে দেয়। তিনি ভয়ে গির্জার উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকেন। আগুনের রোশনাই আকাশ ছুঁই ছুঁই। আকাশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এই বর্ণ তার কাছে খুব ভাল লাগে। তিনি চলতে চলতে বুকে হাত রাখেন। ওখানে কুশের অস্তিত্ব অনুভব করেন। বুকে যেন চাঁদের কুশ চমকাচ্ছে। ক্রশটি তিনি হাতের মুঠোয় পুরেন।