তুমি তো পুষ্প ছিটাওনি। এমন কি নাড়ছ না হাতও। ফ্লোরা! ওখান থেকে সরে এসো। তোমার বাবা নীচে দাঁড়ানো। স্পেন সম্রাটকে দেখার পরও ফুল ছিটাওনি দেখলে উপরে এসে তিনি কেয়ামতের বিভীষিকা কায়েম করবেন।
আমি এদের প্রতি পু থু নিক্ষেপ করতেও ঘৃণা করি। আমি কি ওই সেনানীদের ওপর ফুল ছিটাব যারা খ্রীস্টানদের কচুকাটা করে এসেছে? ধর্মরক্ষা কি আমাদের অভিপ্রায় নয়? ইসলামকে উত্তত করা কি আমাদের এখনকার দাবী নয়? ফ্লোরা বলল।
ভূলে যেও না মা। তোমার বাবা মুসলমান। আমরা নাম কাওস্তের মুসলমান সন্দেহ হতেই তিনি আমাদের হত্যা করে ফেলবেন।
কেন ফ্লোরা গর্জে ওঠে, তাহলে তুমি আমাকে খ্রস্টের শিক্ষা দিয়েছিলে কেন? আজ আবার মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনে বাদ সাধছ কেন? আমার বাবা তোমার স্বামী না হলে সত্যিই তাকে খুন করে ফেলতাম। তোমার প্রেমের প্রতি আমার করুণা হয়, এজন্যই বড় কষ্ট করে নিজকে মুসলমান বাবার কন্যা বলে মনকে সান্ত্বনা দেই। অথচ খ্রীস্টান যীশু আমার পথ প্রদর্শক। খ্রীস্টানদের জন্য আমি জীবনোসর্গ করেছি। আমার বাবার প্রতি তোমার অনুরাগ আছে। তুমি তার শৃঙ্খলে আবদ্ধ– আমি নই।
হ্যাঁ ফ্লোরা! তোমার বাবার প্রতি আমার টান অকৃত্রিম। এতদসত্ত্বেও ধর্মানুরাগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি।
***
১৮ বছরের পুরানো কথা।
তখন ফ্লোরার মায়ের বয়স ১৮। এই সময় স্পেন শাসক ছিলেন আল-হাকাম। স্পেনের করদরাজ্য কতলুয়ানা ছিল খ্রীস্টান অধ্যুষিত। এখানে মাঝে মধ্যে মুসলিম ফৌজ যাতায়াত করত। কতলুয়ানাবাসী ছিল নেহাৎ ধুরন্ধর ও পিশাচ প্রকৃতির। তারা মুসলিম বাহিনীর প্রতি প্রতারণামূলক অসংখ্য হামলা করেছে। সত্যি বলতে কি কতলুয়ানা খ্রীস্টান ষড়যন্ত্রের আখড়ায় পর্যবসিত হয়েছিল।
জনৈক মুসলিম সংবাদদাতা (ইতিহাসে যার নাম খুঁজে পাওয়া যায় নি। যিনি পরবর্তী ফ্লোরার বাপ হয়েছিলেন) কর্ডোভায় এ মর্মে খবর দেন যাতে এক ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। এটা মুসলিম অফিসারের কৃতিত্ব। ইনি ওঁৎ পেতে ছদ্মবেশে এই তখ্যোদ্ধার করেন ও কর্ডোভায় জানান। তৎক্ষণাৎ মুসলিম ফৌজ রওয়ানা হয়। তারা কতলুয়ানায় ঝড়ো বেগে উপস্থিত হয়। সংবাদদাতা এই বাহিনীর পথ প্রদর্শক। তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের ধরিয়ে দেন। কিন্তু সশস্ত্র শহুরে বিদ্রোহীরা ফৌজের মুখোমুখি হয়। খ্রিস্টান নারীরা পর্যন্ত অলি গলিতে মুসলিম ফৌজকে আক্রমণ করে। মুসলিম সেনাপতি কালবিলম্ব না করে বাড়ীতে বাড়ীতে আগুন ধরাল। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করে।
শহুরে লোকদের আবেগ-উদ্দীপনা এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছিল তারা জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাশাপাশি এ তথ্যও উদঘাটিত হয় যে, শহুরেদের লেবাছে ফ্রান্স বাহিনীর অসংখ্য সেনা এখানে এসেছিল।
মুসলিম ফৌজর জ্বালানো গোটা শহরের অর্ধেক জ্বলে ছাই হয়ে গেল। এলাকাবাসী বাইরে বেরিয়ে এল।
দুদিন পর।
সংবাদদাতা কোনো কাজে শহরের বাইরে এলেন। পাহাড়ী এলাকা অতিক্রম করতে গিয়ে তিনি নারী কন্ঠের আর্তনাদ শুনতে পেলেন। তিনি. ঘোড়ার গতিপথ বদলালেন। দেখলেন, জনাতিনেক লোক, এরা ফৌজ নয়। জনৈক সুন্দরী তরুণী নারীর পোষাক খামচাচ্ছে। সে ঘোড়র নিকটে দাঁড়ানো। ওই লোক খাপ থেকে তলোয়ার বের করলেন এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ওই তিন লোক তরুণীকে এভাবে টানা হেঁচড়া করছিল যে, তারা অন্য কারো উপস্থিতি ঠাহর করতে পারল না।
তার ঘোড়া কাছে এলে ওরা আঁচ করল, কিন্তু ততক্ষণে তার উদ্যত তলোয়ারের ডগা একজনের বক্ষছেদন করে ফেলছে। তিনি বর্শার মত তলোয়ার নিক্ষেপ করেই হত্যা করেছিলেন। এবার ঘোড় থামিয়ে দুজনের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা তরুণীকে ছেড়ে তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। খাপ থেকে বের করল তলোয়ার। ছিনতাইকারীরা দুদিক থেকে তাকে ঘিরে নিল। তিনি বিত্তহস্ত–ওদের হাতে অস্ত্র।
এই আগন্তুকের মৃত্যু অনিবার্য মনে হচ্ছিল। এ সময় ত্রাণকর্তার সাহায্য জরুরী মনে করল তরুণী। সে নিহত ছিনতাইকারীর তলোয়ার দ্বারা ওদের ওপর হামলা করলো। শেষ পর্যন্ত ছিনতাইকারীরা সকলেই মারা গেল। অবশ্য উদ্ধারকর্তা মারাত্মক যখমী হলেন।
তরুণী তার ওড়না ছিঁড়ে ক্ষতে পট্টি বাঁধলেন। এ সময় সে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, আমি এক খ্রীস্টান। মুসলিম সেনানীরা আমাদের ঘরে আগুন লাগায়। আমাদের সকলে মারা গেছে। আমি প্রাণভরে পালাচ্ছিলাম। রাতে লুকিয়ে ছিলাম। সকালে ওখান থেকে বেরিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরোই। এ সময় এরা আমাকে ছিনতাই করার চেষ্টা করে।
উদ্ধারকর্তা জিজ্ঞাসা করেন, তোমার গন্তব্য এক্ষণে কোথায়? সে বলল,জানি না।
তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানে তোমাকে পৌঁছে দেব। বললেন তিনি।
তরণীর অবস্থা তখন খুবই করুণ। সে তার পায়ে পড়ল। তিনি বললেন, আমি মুসলমান। তোমাকে সাথে নিতে পারব না। যুবতী জেদ ধরে বলল, গেলে কোথায়ও আপনার সাধেই যাব।
আমার দেহটা ছাড়া আর কিছুই নেই এক্ষণে। একেই এখন পেশ করতে পারি। এর বিনিময়ে আপনার সাথে নিয়ে চলুন এবং শহরের কোনো পাদ্রীর কাছে সোপর্দ করবেন। বলল তরুণী।
আমি কোনো গোনাহের কাজ করব না। তুমি নিরাশ্রয়, অসহায় ও একাকী। আমি তোমার দেহ ওভাবে গ্রহণ করব না। আমার সাথে গেলে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আমার স্ত্রীত্বে আসতে হবে।