এত দীর্ঘ ভূমিকার দরকার কি মুহতারাম যিরাব! কেন বলছেন না, আমীর ও সুলতানার মাঝে যেন না পড়ি আমি! সুলতানা এক আকর্ষণীয় কবিতা, সে আপনার সংগীতও। যে ওটা শোনে মত্ত হয়ে পড়ে, এ এক বাস্তবতা। বাস্তবিক কবিতা তবে কাউকে মত্ত করে না। স্পেন-আমীর আমার স্বামী, কিন্তু আমার কতৃত্বে নন। উনি প্রথমে দেশের সুলতান, এরপর কারো স্বামী। সেই দেশে তাকে খেলাফত কিংবা রাজ্যের প্রতি উদাসীন দেখলে সেটা শুধরে দেয়া অপরিহার্য দায়িত্ব। তিনি এরপরও উদাসীন থাকলে আমার ওপর তাকে হারাম মনে করব।
সুলতানার নেশা যিরাবের মগজ থেকে দূরীভূত হল। মোদাচ্ছেরা বলে চলেছেন, সুলতানার ওপর এমন কোন বিধি-নিষেধ নেই। তিনি বিলাস ও সাজ-সজ্জার এক পিরামিড।
তার শক্তি তো এখানেই। এই সৌন্দর্যই ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। সে যে ফেত্না সৃষ্টি করতে পারে, তা পার না তুমি। তোমার সত্ত্বার শানে আমার আকর্ষণ। তাই বলতে চাচ্ছি, সুলতানার সাথে শুক্রতার কি না নিতে। সে চায়, আমীরে স্পেন ময়দানে ময়দানে বিচরণ করুক। তিনি ফ্রান্সে সৈন্য প্রস্তুত করছিলেন। তার এখানে প্রশাসনিক কাজে থেকে যাওয়া দরকার ছিল। তুমিই তাকে এমন এক শব্দে আবেগতাড়িত করে তুলেছিলে যদ্দন তিনি হেরেম ছেড়ে তলোয়ার হাতে তুলে নিয়েছেন।
ফ্রান্স ও গোথকমূর্চে কাফেরদের সাথে স্পেনের জানবাষ মুজাহিদরা যে সময় জীনপণ লড়াই করবে সেক্ষেত্রে আমার স্বামী সে সময় হেরেমে এক সংগীতজ্ঞ ও খ্যামটা-কুলটা সুন্দরীর সম্মোহনি শক্তিতে বিভোর-এ আমি চাইনি। স্বামী সোহাগের চেয়ে মুসলিম নারীরা জ্ঞাতি সোহাগকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
মোদাচ্ছেরা! আমি তোমায় আবেগে প্রীত। শুধু বলতে চাই, এখানে অভিজ্ঞ সালার রয়েছেন। উবায়দুল্লাহকে তুমি কি মনে কর। আমীরে স্পেনের অনুপস্থিতিতে সে কি নেতৃত্ব দেয়ার অযোগ্য?
না, অযোগ্য নয়। সালার মূসা, আঃ রউফ, করন ঐতিহাসিক যুদ্ধ করে চলেছেন, কাজেই আমীরে স্পেনের সাম্প্রতিককালের অভিযানে না গেলেও চলত।
যিরাব যখন বক বক করছিল তখন মোদাছেরা চেয়ার ছেড়ে উঠে কামরায় পায়চারী করছিল। তার চাল চলনে ছিল এক শ্রেণীর প্রভাব-দাপটের ছাপ। পায়চারী করতে করতে তিনি যিরাবের কাছে এগিয়ে আসেন। তিনি মাথাটা নীচু করে যিরাবের মুখের কাছে এনে সোফায় বসে পড়েন। বলেন, আপনার মুখ থেকে শরাব ও দেহ থেকে সুলতানার প্রসাধনীর ঘ্রাণ আসছে। যে কথা আপনি বলতে এসেছেন, তা সুলতানার এসে বলা দরকার ছিল। কিন্তু তিনি আসলেন না। তার সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনি এক মহান লোক খোদা তায়ালা আপনাকে উঁচু মাকাম দান করেছেন। আপনার মেধা-বিবেকেও শেষ পর্যন্ত এক সুন্দরী নারী প্রভাব ফেলল?
মুহতারাম যিরাব! আপনি আপনার কথা সেরে ফেলেছেন। এবার আমার বলার পালা। সুলতানার মত আমাকে স্পেন-আমীরের মনোরঞ্জনের ইচ্ছে নেই। তার হৃদয়ের কোণে ঠাঁই না থাকলে আমাকে হেরেমে রাখতেন না, বিবাহ করতেন না। হেরেমের অন্যান্য নারীদের মত দাসী বানিয়ে রাখতেন। আমার সম্পর্ক কোনো ব্যক্তি বিশেষের সাথে নয়- সম্পর্ক গোটা জাতির সাথে। স্পেনে যে বিদ্রোহাগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছে তার নেপথ্যে ফ্রান্স সম্রাট লুই ও আল-ফার হাত। এরা ইসলামের মূলোৎপাটন করতে চায়। মাদ্রিদে অভূত্থান ঠিক তখনই হলো যখন আমাদের বাহিনী ফ্রান্স অভিমুখে ধেয়ে যেতে লাগল। এটা এক ষড়যন্ত্রের ফসল। কাফের গোষ্ঠী অ্যুত্থান করে ফ্রান্স অভিযান রুখেছিল। এখন হয়ত সম্রাট লুই ও আল-ফাঞ্চ মাদ্রিদের খ্রীস্টানদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে অন্য কোথাও বিদ্রোহ করতে চেষ্টা করবে। আমার দৃষ্টি এক্ষণে কেবল সেদিকেই।
আপনার প্রতি খেয়াল রেখো মোদাচ্ছেরা!
মুহতারাম যিরাব! আপনার প্রতি যে শ্রদ্ধা-সম্মান আমার আছে তাকে আপনি আহত করে চলেছেন। আমি বলেছিলাম, আপনার মুখে মদ ও শরীরে সুলতানার প্রসাধনীর সুবাস। আপনার জামার ওপর লম্বা চুলটি ঝুলে আছে তা সুলতানা ছাড়া আর কার?
যিরাব দ্রুত জামার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার সাদা জামায় লম্বা একগাছি চুল জড়িয়ে আছে। আঙ্গুলে পেঁচিয়ে তা আলাদা করলেন ও ফরাশে ছুঁড়ে মারলেন।
তিনি কাল আসছেন। মোদাচ্ছেরা বললেন, আসছে আমাদের ফৌজ শহীদী ও যখমী কাফেলা আসছে। তাদের মিছিলে বহু মায়ের পুত্র থাকছে না। থাকছে না বহু বোনের ভাই। বহু পিতা থাকছে না, বিধবাদের স্বামী থাকছে না। তারা স্বভূমি থেকে বহু দুরে মাটির নীচে শুয়ে গেছেন। তাদের যখন কেউ গলা কেটে ফেলেছেন, যন্ত্রণায় আহ-উহ করছেন তখন আপনার গালে মদের উকট গন্ধ আর দেহে সুন্দরীর লম্বা চুল ছিল। যখন ইসলামী পতাকায় রক্তের ছিটে লাগছিল তখন সুন্দরী কুলটা নারীর বাহুবন্ধনে থেকে ভাবছিলেন, আমীরে স্পেনের ওপর কোন নারীর প্রভাব থাকা দরকার।
মোদাচ্ছেরা! যিরাব আহত কণ্ঠে বলেন, সত্যিই তুমি বড্ড আবেগ প্রবণ। তোমাকে বলতে এসেছিলাম, সে তোমাকে আবদুর রহমানের কাছে বিতর্কিত করে তুলবে। তোলার শক্তি তার আছে।
সে কথা আমাকে খুলে বলার দরকার নেই মুহতারাম যিরাব! আমি সবকিছু বুঝেছি। আপনি বলতে চাচ্ছিলেন, আবদুর রহমান ও সুলতানার মাঝে এলে আমাকে হত্যা করা হবে এইতো! কিন্তু আপনার যবানে আছে যাদু। বড্ড চৌকস আপনার মেধা। বড্ড সতর্ক ভরে কথা বলেছেন। যাদুর প্রভাব তার ওপর পড়ে যার মধ্যে ঈমানের লেশমাত্র নেই। যিরাব মোদাচ্ছেরার চেহারায় গভীর নফরে তাকান। সুলতানার চেয়ে তাকে সুন্দরী ও আকর্ষণীয় লাগছে– এটা তার আত্মিক সৌন্দর্য। যিরাব যাতে পুড়ে মরছেন, পারছেন না তার তাপ সহ্য করতে। তিনি ভাবছেন, সুলতানার দূত হয়ে এখানে আসা ঠিক হয়নি। মোদাচ্ছেরা বলে চলেছেন,