কিন্তু তোমার সংগীতকে আমি দংশন করব না। তুমি চাচ্ছ তোমার সংগীতের অপমৃত্যু ঘটুক, পরে স্পেন-নাগিনী তোমার সুরেলা আওয়াজে না আসুক, না ঝাকুক। সর্বোপরি নাগিনীকে সংগীতের সুতোয় বাঁধবে এবং তোমার হয়ে বাঁচবে। যিরাব প্রভু! আমি তোমার। তোমারই থাকব। এসো! আবেগ রেখে খানিক বাস্তব জগতের কথা বলি। যিরাবকে আকর্ষণ করতে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল সুলতানা। তার চুলের উষ্ণ পরশ লাগছে যিরাবের গায়ে, সে বলল; আমাদের স্বপ্নের জগতে এক কালনাগিনী ছোবল মেরেছে।
নিশ্চয়ই সে মোদাচ্ছেরা! যিরাব বললেন, মোদাচ্ছেরা স্পেন সম্রাটের ভেতরের পৌরুষকে উদ্দীপ্ত করেছে-এই বলতে চাও তো!
সম্রাটের ওপর প্রভাব ফেলে জয়ী হয়েছ– এ দাবী মিথ্যা হয়ে গেছে তোমার। তিনি আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছেন। সুলতানা বলল।
সুলতানা! আর্তনাদ করে বললেন যিরাব, তোমার কখনো মনে পড়ে নি– ভালবাসা আমাকে এমন পথেও নিয়ে যায় যেখানে আমাদের যাওয়া উচিত নয়। আমি সঙ্গীত সম্রাট।
তুমি সম্রাট নও গোলাম। এক বাদশাহর গোলাম। কি করে ভুলে গেলে, সালারগণ তোমাকে দরবারী গায়ক বলে থাকেন। আত্ন প্রবঞ্চনার শিকার হয়ো না। তোমাকে সিংহাসনে দেখতে চাই। এই আশায় বেঁচে থাকব, তুমি হবে রাজা আমি তোমার ক্রীতদাসী।
তুমি আমার হৃদয়ের রাণী! এসো আরো নিকটে এসো।
মুচকি হেসে সুলতানা তার আরো কাছে যায়। যিরাব সুলতানার চোখে চোখ রাখেন। চোখের মাঝে সুলতানার দীঘল কালো চুল আড় হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গীত যাদুর ওপর নারী সুষমা প্রভাব ফেলে। ছোট্ট অথচ ক্ষীণকণ্ঠে বেরোয়, যিরী! মোদাচ্ছেরা নামের কণ্টক বিদায় কর।
দীর্ঘক্ষণ তারা আবেগের জগতে ডুবে থাকে। এর মধ্যে শরাবের পেগ পরিবেশিত হয়।
কাউকে পথের কাঁটা মনে করে দূর করার স্বপ্ন মুছে ফেল মন থেকে; যিরাব বললেন, আমি মোদাচ্ছেরাকে আমার প্রভাব বলয়ে আনছি।
তুমি ভুল পথে চলছ- সে কথা বলছ কেন? মুচকি হেসে বলল সুলতানা।
আমার মন বলছে আমার চলার পথেকে যেন বাধার পাহাড় হয়ে আছে। তুমি খায়েশ ও স্বপ্নের মরুতটে বিচরণ করছ।
তুমি সত্যিই মহাবিজ্ঞ যিরী। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আমরা উভয়েই মুসলমান, এ থেকে আমাদের চোখ ফিরানোর জো নেই। খ্রীস্টান যে হারে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, ইসলাম এদেশ থেকে অচিরেই বিদায় নিতে চলেছে। জানো এরপর কি হবে? তুমি হবে খ্রীস্টান দরবারের গায়ক আর আমি খ্রীস্ট সম্রাটের দাসী। এলোগেইছ তোমাকে সবকিছু খুলে বলেছে। তুমি মুসলিম আমীর-নাজিরদের অহযীব-তামাদুন বদলে দিয়ে তাদের ইসলামবিমুখ করায় তিনি যারপরনাই খোশ হয়েছেন। যে খ্রীস্ট শাসন অচিরেই এখানে কায়েম হতে যাচ্ছে আমরা তাদের সাথে টক্কর দেয়ার ঝুঁকি নিতে যাব কেন? আমরা স্রেফ স্পেন সম্রাটকে আমাদের যাদুকাঠিতে মোহন্দ্র করে রাখব। তিনি কাল আসছেন। মোদাচ্ছেরাকে বলল, সে যেন তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তিনি এক্ষণে মোদাচ্ছেরার প্রভাবে প্রভাবিত।
একেতো সুলতানার নেশা এর ওপর আবার মদের নেশা। গভীর রাত। যিরাব সুলতানাকে মাতাল করতে গিয়ে নিজেই মাতাল বনে গেছেন। বলেন, আমি এক্ষুণি মোদাচ্ছেরার কাছে যাচ্ছি।
***
খাদেমার মাধ্যমে যিরাবের আগমন বার্তা পেয়ে দরজায় তাকে অভ্যর্থনা জানান মোদাচ্ছেরা। তিনি কিছুটা অবাক হন যে, এ লোক এত রাতে এখানে কেন?
দরজায় যিরাবকে দেখা গেল। তিনি বললেন, স্পেন-সম্রাটের অপেক্ষায় প্রহর কিভাবে শুনছেন মোদাচ্ছে?
স্পেন সম্রাট নয়- স্পেন আমীর বলুন! ইসলামে কোন সম্রাট হয় না মুহতারাম যিরাব। আপনি রাজনীতিজ্ঞ। আপনি বোঝেন না, এক জন আমীর কি করে সম্রাট হয়ে যান? আমাদের খলিফা পর্যন্ত সম্রাট নন। সম্রাট কেবল আল্লাহ। বলুন এতে করে আপনার অভিমত।
বুদ্ধির সম্রাট মোদাচ্ছেরার অকল্পনীয় কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সৌন্দর্যে সুলতানা অপেক্ষা মোদাচ্ছেরা কোনো অংশে কম নন। মোদাচ্ছেরা বরং সুলতানার চেয়ে অধিক আকর্ষণীয়। যিরাব এভাবে তার বেডরুমে প্রবেশ করেছিলেন যেন তিনি সামান্য এক হেরেমের স্ত্রী। কিন্তু মোদাচ্ছেরার ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ কথায় তিনি নিজকে যতটা হামবড়া মনে করছিলেন ততটা নন।
আপনি বসবেন কি? বললেন মোদাচ্ছেরা।
এদিক থেকে যাচ্ছিলাম তাই আপনার এখানে হয়ে যাওয়া-এই আর কি। বসতে বসতে বললেন যিরাব।
মুহতারাম যিরাব! আপনার মেধা ও বিচক্ষণতার সামনে আমি কিছুই নই। সূর্যের সামনে চেরাগের যতটা তুলনা ততটাও নই আমি। আপনার চেহারা বলে দিচ্ছে, এদিক থেকে যাওয়াচ্ছলে আমার এখানে আসেন নি, বরং আমার উদ্দেশ্যেই আপনার আসা। বলুন। আপনারার কি খেদমত করতে পারি। আপনার স্মৃতিশক্তির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, আমাকে হেরেমের সাধারণ নারী মনে করলে ভুল করবেন-আমি আমীরের স্ত্রী।
যিরাব হেসে বললেন, সুন্দরী নারীদের ধারণাই এমন যে, প্রতিটি পুরুষ তাকে ভিন্ন নযরে দেখে থাকে। আপনার ধারণা এ পর্যন্ত ঠিক যে, আমি এমনিতেই আপনার কাছে আসিনি, এসেছি কিছু বলতে। আপনার ধারণা ভুল যে, আমি আপনার স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে এসেছি। সুলতানার প্রতি আমার অতটা আকর্ষণ যতটা আপনার প্রতি। আপনাদের দুজনের পার্থক্যটাও আমার অজানা নয়।