আপনি কোন ধরনের প্রভাবের কথা বলছেন?
স্পেন সম্রাট একজন রসিক ও মিশুক প্রকৃতির লোক। সেই মিশুক লোককে তুমি ময়দানে নামাতে বাধ্য করেছ। লড়াই তার জন্য নয়, এজন্য ভাড়াটে সেনা ও সিপাহসালার রয়েছে। তারাই দেশকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবে।
তিনি না খোদ নিজে যাচ্ছিলেন, না সিপাইসালারদের যাবার ফরমান দিচ্ছিলেন। তিনি যদি সৈন্য প্রেরণ না করতেন তাহলে ফ্রান্সবাহিনী স্পেনের ওপর হামলা করে বসত এবং মাদ্রিদের বিদ্রোহ দমন সম্ভবপর হত না।
তিনি মারা গেলে তুমি কি বিধবা হতে না? তোমার বাচ্চারা কি এতিম হতো না?
মুসলিম নারীরা খোদার রাহে স্বামী সোহাগকে কোরবান দিয়ে থাকে। তারা সে মুহূর্তে বাচ্চাদের এতিম হওয়ার ভয় করে না। মোদাচ্ছেরার কণ্ঠে দৃঢ়তা, ইসলাম আমাদের থেকে এই কোরবানীই চায়। শহীদের বিধবাকে আপনি ঘৃণার চোখে দেখে থাকেন বুঝি? স্পেন আমীরের সাথে আপনার সম্পর্ক কিসের শুনি? তিনি শহীদ হলে আপনি সেক্ষেত্রে পরবর্তী আমীরের দাসীই তো হবেন-নয় কি?
আমি স্পেন সম্রাটের দাসী নই। আমি তার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি। আমি স্পেনের ভাবী সম্রাটের গর্ভধারিণী।
স্পেনভূমি এতটা নাপাক হয়ে যায় নি যে, তার ভাবী সম্রাট এমন এক বাচ্চা হবে যার মায়ের সাথে তার বাবার বিয়েই হয়নি এখনো। জারজ সন্তান স্পেনের ভাবী আমীর হতে পারে না। আর মনে রাখবেন রূপের রাণী! আপনার মত আবদুর রহমানের হাতে আমি শরাবের পেগ তুলে দেব না– তুলে দেব তলোয়ার।
মোদাচ্ছেরা! সুলতানা গর্জে ওঠল, হৃদয় থেকে আত্মতৃপ্তি মুছে ফেল। আবেগের প্রশ্রয় নিও না। তোমার কাছে মিনতি নয়, সিদ্ধান্ত দিয়ে বলছি, আমীরের ওপর প্রভাব বিস্তার করার পরিণতি ভাল হবে না।
আপনার হুকুম আমি মানতে প্রস্তুত নই। বিবাহিত কোনো নারী স্বামীর দাসীর হুকুমে চলে না। আমি বনী উমাইয়ার মেয়ে, দাসী নই। মোদাচ্ছেরা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সুলতানা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল, অচিরেই টের পাবে, হুকুম দাসীরটা চলে না স্ত্রীরটা।
২.২ ফ্লোরা
কর্ডোভার হেরেমে সেই জৌলুস নেই ইতিপূর্বে যা ছিল। আমীরে স্পেন মাদ্রিদে ছিলেন যেখানে রক্ত নদী বয়েছে। মাদ্রিদে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বহু সেনা শহীদ হয়েছেন। যখমীদের ফিরিস্তিও কম নয়। মাদ্রিদ লাশের শহরে পরিণত। কর্ডোভা এজন্য মর্মাহত, নিঝুম পুরীতে পর্যবসিত। কর্ডোভাবাসী শেষ পর্যন্ত বিজয় সংবাদ পায়। তবে এতে উদ্ভট বানোয়াট সংবাদও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাদের ছেলে এই যুদ্ধে শামিল ছিল তার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ে আমীরে স্পেন আগামীকাল আসছেন।
হেরেম সেজেছে নয়া দুলহানের বেশে। জৌলুসহীন হেরেমের আজ শেষ রাত। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সংঙ্গীতজ্ঞ তার বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে গেছে। যিরাব বাদ্যযন্ত্রে প্রাণ এনেছেন। তিনি এর প্রতি সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজে আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন।
তিনি রোমান গীত শুরু করেন। এই সংগীতের আবিস্কারক তিনি নিজেই। তার সুরলহরী হৃদয়তন্ত্রীতে ঝড় তোলে। তার সেতারার সুর উজ্জীবন শক্তি। দরোজার পিঠ করে তিনি সুর তুলে চলেছেন। তার সুরের শব্দমঞ্জুরীতে নারী সৌন্দর্যের পিরামিড দরজায় ফুটে ওঠে। নারীমূর্তি যিরাবের সুরে তন্ময়। যিরাব ওদিকটায় তাকালে দেখত প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবিই তার সুরে ও আবেগের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। নারী সুষমার বাস্তব প্রতিচ্ছবি সুলতানা।
আমীরে স্পেন কর্ডোভায় ছিলেন না বিধায় সুলতানা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন। তার রেশমী কোমল একরাশ কুন্তল ঘাড়ের শোভা বর্জন করে চলেছে। কাঁধ খোলা। দর্শকের দৃষ্টি এখানে পড়লে চমকে উঠতে বাধ্য। যিরাবের সেতারে সুর তাকে মোহিত করে তোলে। দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজকে আগে জাগিয়ে পরে যিরাবকে জাগাতে চায় সে। তার ধারণা যিরাবের সামনে গেলে তন্ময়তা কেটে যাবে।
যিরাব গানের কলি দোহরায়। ওই গানের প্রতিপাদ্য নারী সুষমা। জান্নাতের হর-ই কেবল হতে পারে তার কল্পনার সেই নারী। সুলতানা দিল-দিমাগে ঝড় তোলে। একসময় বাড়ে সুরের মূর্ঘনা। সুলতানার কথায় ভেঙ্গে যায় যিরাবের সংগীত সাধনা, তোমার গানের সেই নারী কেবল আমিই হতে পারি। এ আমার সৌন্দর্য ও প্রেমের সংগীত। আমার সৌন্দর্য-পূজার কি অপার কসরত।
সুলতানা যিরাবের দিকে এগিয়ে যায়। সেতারের তার থমকে যায়। বলে, তুমিই আমার কল্পনার ছবি?
সুলতানার মুচকি হাসি দুঠোঁটে খেলে যায়। যিরাবের হাত তার ভোলা কাধ স্পষ্ট করে। সুলতানা হাসে। হাসিতে জলতরঙ্গের ঢেউ। জড়িয়ে ধরে কাপেটে বসায়। বলে, আমায়ও সেতারের অনুভূতি কখনো পাগল করে তোলে। সে আওয়াজে তোমার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। এমতাবস্থায় দেখি তুমি হাজির।
আমি কি কোন নাগিনী যে সাপুড়ের বাঁশির মোহতানে হাজির হয়ে যাই?
সত্যিই তুমি নাগিনী সুলতানা। তোমার বিষেও সৌন্দর্য রয়েছে। রয়েছে যাদু ও নেশা। সুলতানা! আমি সেই লোক যে দোর্দণ্ড প্রাতপশালী শাসক, আলেম ও বীর বিক্রম আঃ রহমানের ওপর প্রভাব ফেলে বিজয়ী হয়েছি। তুমি দেখে থাকবে আমীর-উমরাগণ পর্যন্ত আমার মাধ্যমে তার দেখা পায়। আমার দ্বারাই তায়-তদ্বির করে। কিন্তু তুমি সামনে এলে মনে হয় আমি পরাজিত হয়ে গেছি, তুমি আমায় দংশন করেছ, আমার ওপর তোমার যাদু কার্যকরী হয়েছে।