এরপর তার দৃষ্টি এক সময় সুলতানার ওপর পড়ে। সুলতানার অনিন্দ্য সুন্দর মুখ ও নিটোল দেহবল্লরীতে যাদুর কারিশমা। আবদুর রহমান স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি ভেবে পান না যে, তার দেশে এমনও রূপের রাণী বর্তমান। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না যে, সুলতানা নিজে আসেনি তাকে আনা হয়েছে।
স্পেনের অন্যান্য রাতের মত একটি রাত। আবদুর রহমানের প্রাসাদে সংগীতের সুর-মূৰ্ছনা। সংগীত সম্রাট যিরাবের সুনিপুণ বাদ্যযন্ত্রে সম্মোহনী টান। জারিয়া তার পার্শ্বে উপবিষ্ট। বাঁশির সুরে দ্বিতীয় আবদুর রহমান এতটা নিমগ্ন যে, তিনি ঠাহর করতে পারছেন না। তিনি স্পেনের বাদশাহ। তিনি ঠিক তখনই বিলাসিতায় নাক অবধি ডুবছেন যখন তার প্রাসাদ ঘিরে ক্রুসেডের ষড়যন্ত্রজাল। তিনি ভুলে গেছেন যে, তাকে ইসলামের সুমহান দাওয়াত নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। অন্ধকার ইউরোপে হকের মশাল জ্বালাতে হবে, যাতে নিপীড়িত মানবতার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সিংহশাবক
ইসলামী খেলাফতের এই আমীর তার বাবার মত নিজকে একজন স্বাধীন রাজা মনে করতেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভোর না থেকে সংগীত চর্চায় মেতে ওঠেন।
একদিন তুরুবের প্রাসাদে জনৈক দরবেশ প্রবেশ করলেন। এই দরবেশকে ইতিপূর্বেও সুলতানা তার মহলের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন। একবার সুলতানা তার গতিরোধ করে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়াছিলেন। সুলতানা শুভ্র ঘোড়া গাড়ীতে সওয়ারকালীন ওই দরবেশকে পথ চলতে দেখে সখীকে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে বেটা কোন সেঁক খাওয়া প্রেমিক। কতবার এপথে তাকে চলতে দেখেছি।
মনে হচ্ছে লোকটা ভিক্ষুক। সখি বলেছিল।
না। সুলতানা বললেন। ভিক্ষুক নয়? তার চেহারায় এক ধরনের আভিজাত্য রয়েছে যা তাকে অভিজাত বলেই মনে হতে বাধ্য করে। চোখে-মুখে বুদ্ধির রেশ। পুরুষের চেহারা শনাক্ত করতে আমি কখনই ভুল করি না।
সখী মুচকি হেসে বলেন, দরবেশ হোক আর সপ্ত মহাদেশের বাদশাহ হোক, তোমার রূপ-লাবণ্যের সম্মোহন সকলের তরে সমান।
সুলতানা ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকালেন। দরবেশ পূর্বস্থানেই দণ্ডায়মান। তার দৃষ্টি সুলতানার ঘোড়ার গাড়ীকে লেহন করছে। এ যেন টিকটিকির চুপিসারে আসামী অনুসরণ। সুলতানার গাড়ী এগিয়ে চলছে। সূর্য ডুবু ডুবু ভাব। দরবেশ পূর্বস্থানে দাঁড়ান। প্রত্যাবর্তনের পথে তাকে দেখে সুলতানা চমকে ওঠেন। তিনি গাড়ী থামান। ইশারায় তাকে কাছে ডাকেন। দরবেশের চোখের রঙ নীল, দেহ বাদামী, দাড়ি আধাপাকা।
তোমাকে আমি কয়েকবার দেখেছি, সুলতানা বললেন, আমাকে যেভাবে পর্যবেক্ষণ কর সেভাবে কি প্রত্যেক নারীকেই পর্যবেক্ষণ কর?
দুনিয়ার কিছু নারী সুলতানার চেয়ে সুন্দরী হলেও ভোমার সৌন্দর্য কিছুটা ভিন্ন। অন্যের সৌন্দর্য চোখ ঝলসে দেয় আর তোমারটা হৃদয়ে উষ্ণ পরশ বুলায়। আর যাদের রূপ-লাবণ্য হৃদয়ে টোকা মারে তারা পার্থিব নারীদের চেয়ে ভালো হবেই। দরবেশ বললেন।
নিছক আমাকে দেখার জন্যই কি আমার মহলের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে? প্রশ্ন সুলতানার।
হা! এর সাথে কিছু বলার জন্যও।
কি বলার জন্যে?
যাদের দৃষ্টি তোমাকে লেহন করছে ওই দর্শকদের সামনে দরবেশ তোমাকে কিছু বলতে পারে? দেখ রাণী! পথে পথে লোক তোমাকে কি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আমি তোমাকে এমন পথ দেখাতে চাই যে পথে দৰ্শককুল কেবল তোমার রূপসুধা পান করবে না বরং শ্রদ্ধায় মস্তকাবনতও করবে। সুলতানার জন্য স্পেনের সিংহাসন অপেক্ষমান।
তুমি যদি গণক হয়ে থাক এবং আগামী দিনের কথা আগাম বলে দিতে সক্ষম হও তাহলে আজকের রাতটা আমার মহলে থেকে যাও। দারোয়ান তোমায় রুখবে না।
রাতের বেলায় দারোয়ান রুখা তো দূরে থাক বরং সসম্মানে সুলতানার কামরায়, পৌঁছে ছিল। এই কামরায় সাধারণত সুলতানা ছাড়া আর কারো প্রবেশের অনুমতি নেই। সুলতানা অর্ধনগ্ন মিহি রেশমী পোশক আচ্ছাদিত। পিঠে আছড়ে পড়া একরাশ কেশ ওই রেশমের চেয়েও মোলায়েম। ঝাড়-ফানুসের আলোয় তার রূপটা গোটা কক্ষকে আরো উজ্জ্বল করে তুলছে। সুলতানা উত্থিত যৌবনা। তার কণ্ঠে সংগীতের সুরলহরী। চাল-চলন যাদুকরী। কথন-বচন গভীর। হাসিতে শরাবের মাদকতা।
ইতিহাস লেখে, খোদা তাকে যেমন রূপ-যৌবন দিয়েছিলেন তেমনি দিয়েছিলেন মেধা ও বিচক্ষণতা। ছুটন্ত চঞ্চল হরিণীর ক্ষিপ্রতা। চোখে প্রেম ও আকর্ষণের অধীর চাহনি। পক্ষান্তরে তিনি ছিলেন প্রতারক ও শ। তিনি আপনার মূল্যায়ন জানতেন এবং পুরুষকে হাত করার কৌশল রপ্ত করেছিলেন। রূপের দরিয়ায় ঝড় তুলে বীর পুরুষকে কুপোকাত করতে তার জুড়ি নেই।
দরবেশ এই অপ্সরাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ শেষে চেহারায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।
তুমি কি করে বললে, স্পেনের সিংহাসন আমার জন্য অপেক্ষমান? সুলতানা প্রশ্ন করেন।
এটি রূহের জগতের কথা রাণী! আমি যদুর জানি, আপনি রাণী হওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী। কিন্তু কোন পন্থা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাছাড়া অদ্যাবধি এমন কাউকে পাননি, যে আপনাকে দিতে পারে সে পথের সন্ধান। দরবেশ বললেন।
তুমি সে পথ দেখতে পারলে আমার অর্ধেকটা জায়গীর তোমায় এনাম দেব।
এনাম চাই না রাণী। খাজানা আমার চারপাশে অঢেল। কিন্তু সেটা আমার জন্য বেকার। আমি এ জগতের মানুষ নই। নই জ্যোতিষী, বরং আমি গণক। স্পেনরাজ দ্বিতীয় আবদুর রহমান তোমার পথ চেয়ে বললেন দরবেশ।