কমান্ডাররা এখন আমীরের কঠে এ আওয়াজ শোনেন যিরাব ও সুলতানার কোপানল মুক্ত। বিলক্ষণ তারা শংকা করছিলেন, আবদুর রহমান না আবার যিরাব ও সুলতানাকে এখানে ডেকে পাঠান। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে আবদুর রহমান বলেন, ফ্রান্স সম্রাট লুইয়ের লেজে আঘাত করতে হবে। ফেত্নার উৎপত্তি যেখান থেকে সেখানেই তাকে প্রতিহত করতে হবে। মাদ্রিদের অবরোধ সফল হলে ওখানকার কাউকেই ক্ষমা করা হবে না। ইতিহাস আমাকে রক্ত খাদক হিসেবে চিহ্নিত করলে করুক। ব্যক্তিস্বার্থে একফোঁটা খুন ঝরালে ইহকালে-পরকালে খোদা আমাকে সাজা দিন, কিন্তু জেহাদের প্রতি আমি অকুণ্ঠচিত্ত। কাফেররা অস্ত্র সমর্পণ করুক, ক্ষমা ভিক্ষা চাক কিংবা পরাজিত হয়ে তোমাদের কদমে পড়ুক তথাপিও ওদের বিশ্বাস নেই।
কিন্তু আমীরে মুহতারাম! কোরআন বলছে দুশমন সন্ধির হাত বাড়ালে তাতে সাড়া দাও। করন বললেন।
কিন্তু কোরআন এও বলেছে, ওদের ওপর কোনো প্রকার ভরসা করো না। ওদের সাথে সখ্য, করো না। মুসিবতে পড়লেই নিরূপায় হয়ে ওরা সন্ধির প্রস্তাব করে। অবস্থার পরিবর্তন হলেই ওরা তোমাদের না জানিয়েই সন্ধিভঙ্গ করবে। দেখছ না আমাদের মাঝে কি করে ফেত্না গজিয়ে উঠছে একের পর এক। মাদ্রিদে অভ্যুত্থান ঠিক তখনই হলো যখন আমরা ফ্রান্সভিমুখী হই। বিদ্রোহীরা ফ্রান্স হামলা থেকে আমাদের বিমুখ করতেই এই অত্যুথান করেছে।
বিদ্রোহীদের পুরোধাকে আপনি চেনেন কি? প্রশ্ন মূসার।
মাদ্রিদের বিদ্রোহাগ্নি তো মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারই জ্বেলেছে, কিন্তু তার খুঁটির জোড় খ্রীস্টান জাতি। বললেন আবদুর রহমান
ওদের একজনের নাম এলোগেইছ। অপর একজন ইলিয়ার মূসা বললেন।
ওদের দুজনকেই গ্রেপ্তার করতে হবে। মাদ্রিদ থেকে কোনো খবর আসছে না। উবায়দুল্লাহ হয়ত খুব শীঘ্ৰ মাদ্রিদ ঢুকবেন। বললেন আমীরে স্পেন।
***
সালার ওবায়দুল্লাহ দ্রুত শহরে প্রবেশ করতে চাচ্ছিলেন। দেয়ালে সুরঙ্গ সৃষ্টিকারী জানবাব মুজাহিদরা ক্রমশ শহীদ কিংবা যখমী হয়ে যাচ্ছিলেন। প্রাচীরের ওপর থেকে তীর, পাথরও অগ্নিবান পরিস্থিতিকে নাযুক থেকে নাযুকরো করে ফেলছিল। খণ্ড বাহিনীর প্রধানের উদ্দীপনা দেখে তিনি মনে করছিলেন, তারা ত্বরা করেই শহরে ঢুকতে পারবেন। তিনি বলেছিলেন, দেয়াল টপকাতে না পারলে বিদ্রোহীরা শহরবাসীদের দুঃসাহস আরো বাড়িয়ে তুলবে। কর্ডোভার মিনজানিক মাদ্রিদবাসীদের সাহসে এতটুকু ভাটা ফেলতে পারছে না। কেননা কামান দাগানোর সুযোগ দিচ্ছে না।
ভেতরে এক লোক কর্ডোভা বাহিনীর রাস্তা সাফ করার ব্যবস্থা করছিলেন। যুবতীরাই তার সাথী। যুবতীদের সাথে দুলোক। এদের হাতে তলোয়ার, খঞ্জর ও তীর-ধনুক, ওদের দরকার পুরুষ বেশে সাজা, কিন্তু পুরুষের পোশাক অপ্রতুল।
গভীর রাতে আবু রায়হান এদের নিয়ে বেরোলেন। নিলেন প্রচণ্ড ঝুঁকি। এক্ষণে তাদের দরকার কিছু হৈ-হুঁল্লোড়। ঘটনাক্রমে হৈ-হুঁল্লোড় লেগে যায়। বেশ কিছু পাথর বসতবাড়ীর ছাদে পড়ে। বসতির লোকজন ঘরদোর ছেড়ে বেরোয়। গোটা শহরে হুলুস্থুল পড়ে যায়।
***
আবু রায়হান দক্ষিণ ফটকে এগিয়ে যান। এর পূর্বে শেষবারের সঙ্গীদের নির্দেশনা দেন। বলেন, এবার একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যাও, যেন তোমাদের কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সফরে দ্রুত এদের মত চল। কেননা আস্তে চললে মানুষ সন্দেহ করতে পারে।
ফটকের কাছাকাছি চলে এলেন তিনি। ওখানে দপদপ করে গোটাচারেক মশাল জ্বলছে। শহরের হৈ চৈ-এ প্রবৃদ্ধি আসে। ফটকের ওপরে-নীচে কম করে হলেও এক জনের বিচরণ। প্রহরীরা এভ-ক্লান্ত। আবু রায়হান তার সঙ্গীদের আড়ালে রেখে দরজার কাছে যান। তিনি ওদের ভাষা জানতেন। খুবই ঘাবড়ে তিনি বলেন, এত লোক এখানে কি করছ। ওই পাশের ফটকে কোনো প্রহরী নেই। মুসলিম বাহিনী ওই ফটক ভাংতে চেষ্টা করছে। ওরা বলেছে, এখানে মাত্র চারজন লোক যথেষ্ট। বাদ বাকীরা ওদিকে যাও। জলদি যাও, কাপুরুষের জাতি। শহর হাতছাড়া হয়ে গেল।
কারা দরজায় থাকবে আর কারা যাবে অতিশীঘ্র তিনি তা নির্ধারণ করেন। মাত্র চারজন লোককে রেখে বাদবাকীদের হাঁকিয়ে দেন। আবু রায়হানও ওখান থেকে সরে যান। তার বাহিনী ওই চার প্রহরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুবতীরা বর্শা ও তলোয়ার দ্বারা এদের যমালয়ে পাঠায়। সকলে ফটক খুলে ফেলেন। আবু রায়হান সঙ্গীদেরকে দ্রুত মুসলিম শিবিরে গিয়ে খবর দিতে বলেন, কয়েকজনকে এখানে থাকতে বলেন।
উপরের বুর্জ থেকে তিন/চার জন লোক নীচে চলে আসে। মশাল জ্বলছে। তারা দরজা সামান্য খেলা দেখতে পেল। ওখান থেকে আবু রায়হান বেরুচ্ছিলেন। আরো দেখল, তাদের বেশ কজন প্রহরীর লাশ। এদের একজন আবু রায়হানকে লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করল। বর্শাটি গিয়ে তার পার্শ্বদেশে গেথে গেল। যুবতীরা এই চারজনকে শেষ করে দিলেন।
আবু রায়হান জমিনে লুটিয়ে পড়লেন। অবশিষ্ট সাথীরা এগিয়ে এল। তিনি বললেন, সামনে বেড়ে ডান দিয়ে মোড় নিও। ওদের বলো, দক্ষিণের দরজা খোলা। বাকীরা তোমরা দরজার ওপাশে ওঁৎ পেতে থেকো। কেউ যেন দরজা বন্ধ করতে না পারে।
***
মানব ও ঘোড়ার স্রোত দক্ষিণ গেটে ছুটে আসছিল। প্রাচীর থেকে শাঁ শাঁ করে তীর ছুটে আসছে। বেশ কজন ওই তীরাঘাতে ঘায়েল হয়। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর উদ্দীপনায় ভাটা ফেলতে পারে না। এরা সুদক্ষ, সুশিক্ষিত বাহিনী। কেল্লা ও ফটক দখল করার কৌশল ওদের জানা ছিল। প্রতিটি সৈনিক জানে এ মুহূর্তের করণীয় কি! একদল দরজা ভেদ করে ভেতরে গিয়েই প্রাচীরে উঠে যায়। মশাল নিভিয়ে প্রাচীরে রক্ষীদের পাইকারী হত্যা শুরু করা হয়।