***
গর্তে লুকানো মুসলিম আত্মগোপনকারীদের রাতেই জানানো হলো, বাইরে কি হচ্ছে তার কিছু আশা করা যাচ্ছে না। তবে মুসলিম বাহিনী অতি অবশ্যই দরজা ভাঙ্গার প্ল্যান নিয়ে থাকবে। কেননা দরজা ভাঙ্গা ছাড়া অবরোধ সফল হবে না– এতে প্রাণহানি যতই ঘটুক না কেন তাদের।
পরদিন সকালে মুখে নেকাব লাগিয়ে আবু রায়হান বেরিয়ে পড়েন। প্রাচীরে চড়েন এক সময়। দেখেন কর্ডোভা বাহিনীর অবস্থান। দিগন্তে লকলকিয়ে ওঠা ফসলী ক্ষেত। উবায়দুল্লাহ ওই ফসলগুলো কেটে ফেলতে বলেন। হাজারো ফৌজ তলোয়ার দ্বারা ফসল কাটা শুরু করেন। পরে ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে আটি বেঁধে ওগুলো নিয়ে আসা হয়। ফলদার বৃক্ষগুলো কুঠারাঘাতে ধরাশায়ী করা হতে থাকে। আবু রায়হান প্রাচীরে দাঁড়িয়ে কতবার দেখেছেন, সুরঙ্গ করার জন্য কর্ডোভার জানবার্য সেপাইরা আগে বাড়লেও তীয়বৃষ্টির সম্মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটেছে। তাকে কেউই চিনতে পারেনি। দেয়াল থেকে নেমে এলেন তিনি। তার মনে এক নতুন পদ্ধতি এসে যায়। দরকার এক্ষণে তার কাগজ-কলম। তিনি একটি দরোজায় করাঘাত করেন। জনৈকা মহিলা দরজা খুলে দেয়। তিনি বলেন, তিন চারটা কাগজ, কলম ও কালি দরকার। কমান্ডারদের কালি লাগবে। তখনকার মানুষের রক্ত দিতেও প্রস্তুত। ওই মহিলা ফওরান কাগজ, কালি ও কলম এগিয়ে দেন।
আবু রায়হান এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে গর্তের একপাশে চলে যান। কাগজে কিছু লেখে গুহার লোকদের হাতে সোপর্দ করেন। প্রতিটি কাগজের ভাষ্য একই।
দক্ষিণ দিক থেকে ফৌজ হাটিয়ে নিন। বেশী বেশী প্রহরা প্রধান ফটকে রাখুন। বিদ্রোহীরা দক্ষিণ দরজা থেকে ফৌজ খালি করতে যাচ্ছে। রাত আমরা দক্ষিণ দরজা ভাংতে চেষ্টা করব।
এই কাগজের নীচে তিনি আপনার নাম ও পদবির উল্লেখ করেন। চিরকুট তিনটি মুড়ে পৃথক তিনটি তীরের মাথায় গেঁথে দেন। এই তীর তিনটাসহ একটা ধনুক নিয়ে বের হন। কেউ দেখতে না পাক এভাবে চুপিসারে গুহার মুখ থেকে বের হন এবং প্রাচীরে চড়েন। এদিকটায় প্রহরী নেই দেখেই তিনি এখানটায় চড়েন।
তিনি আরেকটু দক্ষিণ দিকে যান। তার ধনুকটি বড় মজবুত। ধনুকটা যতটুকু বাঁকানো যায় ততটুকু বাঁকিয়ে তীর নিক্ষেপ করেন। প্রথমটা মেরে দেখেন যথাস্থানে পতিত হলো কিনা? আঁ! তিনি জানেন প্রতি তীরই সৈন্যদের মাঝে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পড়েছে এবং কর্ডোভা বাহিনী তা তুলে নিয়েছে।
ওই তিনটা তীরের একটা সালার আবদুর রউফের শিবিরের সন্নিকটে পতিত হয়। জনৈক সেপাই ওটি উঠিয়ে সালারের কাছে পৌঁছে দেন। আবদুর রউফ চিরকুটটি প্রধান সালারের কাছে নিয়ে যান। তিনি বলেন– এটা ধোকাও তো হতে পারে।
হ্যাঁ, এর একটি কারণ থাকলেও থাকতে পারে, চিরকুটের কথামত আমরা দক্ষিণ দিকটা খালি করে দিলে দুশমন ওদিক থেকে বেরিয়ে আমাদের ওপর হামলা শানাতে পারে। এমনটা হলে এ থেকে আমরাও ফায়দা লুটতে পারি। বিদ্রোহীরা বাইরে এলে ওদের একটাকেও ভেতরে যেতে দেব না। বরং আমরাই সে সময় ভেতরে যাব। বললেন আবদুর রউফ।
দ্বিতীয়ত দরজা উন্মুক্ত দেখে ভেতরে ঢুকলে হয়ত দেখব দুশমন ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে আছে। বললেন সালারে আলা।
আমাদের দরজা খোলা দরকার। আমার খণ্ডবাহিনী তাহলে টর্নেডো গতিতে ভেতরে ঢুকবে। যে কোন অবস্থায় আমাদের ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত তো সেই প্রথম থেকেই নেয়া হয়েছে।
সূর্যাস্তের সময় দক্ষিণ দিকের বাহিনী তাঁবু টাল। ভাবখানা যেন অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। ওদিকে পশ্চিম দরোজায় প্রচণ্ড হামলা চলছে। প্রাচীর রক্ষীদের যারা এদিকে সেদিকে ছিল তাদের সকলের দৃষ্টি প্রধান দরজায় পড়ল এবং সকলে ওই দরজা রক্ষা করতে এগিয়ে এলো। এদিকে দক্ষিণ দিকের মুসলিম বাহিনী পিছু হটছে দেখে বিদ্রোহীরা ওই দিকের বাহিনীকে অন্যত্র সরিয়ে দিল।
সূর্যাস্তের পর আবু রায়হান গুহার ভেতরে এলেন। বললেন, আমার পয়গাম পৌঁছে গেছে। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আমাদের বাহিনী সরে গেছে। কাজেই আমাদের সালাররা আজ ওই দরজা খোলার অপেক্ষায় থাকবেন। দরজাটা খোলার ব্যবস্থা করা দরকার। আমি যে প্ল্যান করেছি তাতে তিনজনে কাজ হবে না। কমপক্ষে দশজন চাই।
সে চাওয়া আমরা পূরণ করব। প্ল্যানটা আগে বলবেন কি। জনৈকা যুবতী বলল।
হা! ওদের নিয়ে যাও। বৃদ্ধ বললেন।
তবে এদের পুরুষের বেশে যেতে হবে। কারো সন্দেহ হলে সেরেছে। বললেন আবু রায়হান।
পরিস্থিতি সে পর্যন্ত গেলে আমরা জানবামি রাখতে কুণ্ঠিত হব না। জনৈকা যুবতীর কণ্ঠে দৃঢ়তা। এরপর আবু রায়হান তার প্ল্যান বলে গেলেন।
***
মাদ্রিদ থেকে দূরে অবস্থানরত আবদুর রহমান তার বাহিনী ছদ্মবেশে দূর দূরন্তে ছড়িয়ে দেন। এদের মাধ্যমে পালাক্রমে যাবতীয় তথ্যাদি তার কাছে পৌঁছুতে থাকে। গেরিলা বাহিনী ঘোড়ায় চেপে বিভিন্ন পয়েন্টে ওঁত পেতে পরিস্থিতির প্রতি গভীর নযর রাখে। ছাউনির কেন্দ্রবিন্দুতে হেড কোয়ার্টার থাকলেও দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তিনি ঘোড়ার পিঠেই থাকেন। কমান্ডারদের কাছ থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করেন। সালার মূসা ও করন তার সঙ্গী।
আবদুর রহমান আপাদমস্তকে সিপাহীসুলভ অভিব্যক্তি। মনে হত রণাঙ্গনেই তার জন্ম আবার মৃত্যু সেই রণাঙ্গনেই, এমন কি দাফনও। এক সময়কার সংগীতের সুর, মূৰ্ছনা ও নারী সৌন্দর্যে বিভোর আবদুর রহমান এখানটায় ঠিক এভাবেই বিচরণ করতেন যেন চিতাবাঘ তার শিকার খুঁজে ফিরছে। তার আত্মিক ও জাগতিক শক্তির দুটোই এক্ষণে জাগরুক। মানসিক ইদ্রিয়ানুভূতি এমন যে, ওটা যদি অতিন্দ্রীয়ভাবে আত্মার সাথে দেহের সংমিশ্রণ ঘটে তাহলে তা বজ্রবিদ্যুৎ ঘটতে সময় লাগবে না। একরাতে তিনি অধীনস্থ কমান্ডারকে বলেন, আমরা এখান থেকে তাঁবু গুটাব ভাবলে দুশমনকে হতাশই হতে হবে। ইসলামী সাম্রাজ্য সংকুচিত হওয়ার স্থলে ক্রমশই এর সীমা বিস্তার লাভ করবে। স্পেন আমাদের পূর্ববর্তীদের রক্ত আমানত। স্পেন ইসলাম ও ইজ্জতের প্রতিভূ। আমারা একে রক্তের মাধ্যমে পবিত্র ও হেফাজতে রাখব।