ভূত-পেত্নীকেও তিনি খোদার সৃষ্টি মনে করতেন। খোদা তায়ালা তাকে এই মুসিবত থেকে বাঁচাবেন বলে তার বিশ্বাস। বাচ্চার কান্না থামার পর আরবী ভাষায় পুরুষ কন্ঠে বলতে শুনলেন,
ওকে দুধ দাও কিংবা গলা টিপে দাও। পরক্ষণে নারীকণ্ঠে শোনা গেল, এ আওয়াজ বাইরে যাবে না।
আবু রায়হান একে জীবিত মানুষের আওয়াজ বলে মনে করছেন না। তারপরও লঘুপায়ে তিনি আগে বাড়েন। কুপির টিমটিমে আলো তাকে আরো ধোকায় ফেলে দেয়। যে কোনো পরিস্থিতি হজম করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। আচমকা কারো কড়া নির্দেশে তার মোহভ হয়। কে যেন বলে, দাঁড়াও। একচুলও নড়বে না। খোলা তলোয়ারের ডগা তার পিঠে ছুঁয়ে আছে। নির্দেশটা আরবী ভাষায়।
কে তুমি? আবু রায়হান আরবীতেই প্রশ্ন ছোঁড়েন, প্রাণে মারার আগে আমার কথা শোনো। আমি মাদ্রিদ বাহিনীর কমান্ডার। নিরস্ত্র করে আমাদের বন্দী করা হয়। আমি কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছি, এখান থেকে শহরের বাইরে বেরোতে আমার আসা।
ইতোমধ্যে একটা কুপি আনা হয়। যিনি কুপি এনেছেন তার অপর হাতে নাঙ্গা তলোয়ার। ওই লোক জিজ্ঞেস করেন, লোকটা কে?
আবু রায়হান আমার নাম। ফৌজি কমান্ডার।
তার পেছনের লোকটা সামনে এলো। আবু রায়হান বললেন, তোমরা জিন্দালোক,
অশরীরী আত্মা। যাই কিছু হও না কেন, আমাকে বলল। অশরীরী আত্মা হলে নিশ্চয়ই আরবী হবে। তবে আরবী হলে প্রেতাত্মা হতে পার না-নেককারই হবে। আমাকে সাহায্য কর। আকে শহরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দাও। আমি আমার ফৌজ নিয়ে আসব এবং কাফেরদের মাদ্রিদ থেকে বের করে দেব।
আগে বাড়ো।
***
কামরাটি অতি প্রশস্ত।
দুটি কুপি জ্বলছে টিমটিম।
ওখানে ১০/১২ জন যুবতী ও ৩/৪ জন বয়স্কা মহিলা। জনৈকা মহিলা বাচ্চাকে দুধ পান করাচ্ছিলেন। পুরুষ মাত্র দুজন, যারা আবু রায়হানকে ভেতরে নিয়ে এসেছে এদের একজন বৃদ্ধ। তিনি আবু রায়হানকে বললেন, ওদের দেখো! আমাদের মেয়ে। সেই আরবী মেয়ে যারা মাদ্রিদে বসবাস করত। ওদের কারো বাপ, আর কারো ভাই শহীদ হয়েছে। আমাদের বেশ কিছু নারী কাফেরদের হাতে চলে গেছে। এদের কোনক্রমে কাফেরদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছি, ওরা এখানে ভালই আছে।
কার অপরাধে আমাদের এই পরিণতি। বৃদ্ধ বললেন, এই কাফেররা বিদ্রোহের অগ্নিকুণ্ডলী তৈরী করছিল। মোহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বার আকাম-কুকাম করে খ্রীস্টানদের সাথে হাত মিলিয়েছে সেই কবে। অথচ কর্ডোভার আমীর এখানে সৈন্য বুদ্ধি করেননি। এমন কি ননীর পুতুল মাদ্রিদের আমীর এতটুকু ঠাহরও করতে পারেননি যে, মাদ্রিদ এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।
এসব পেঁচাল পেড়ে এখন লাভ? আবু রায়হান বললেন, বাইরের অবস্থা সম্পর্কে খুব সম্ভব তোমাদের কোনো ধারণা নেই।
না। এক লোক বলল, সত্যিই আমরা বাইরের কিছুই জানি না। বলতে পার অভ্যুত্থানের পর কতদিন অতিবাহিত হয়েছে? আমরা পোকা-মাকড়ের মত দিন গুজরান করছি। এই মেয়েগুলো নিয়ে সমস্যায় আছি। ইজ্জতের সাথে আমরা বেরুতে চাই।
আমি একাকী বেরুতে চেষ্টা করছি। তবে এ সমস্যা আমারও। আমি এ ব্যাপারে আপনাদের সঙ্গ দেব। বাইরের অবস্থা এ মুহূর্তে ভাল নয়। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার মাদ্রিদের স্বাধীন বাদশাহ। খ্রীস্টানরা তার আনুগত্য কবুল করেছে। ওদের দুলিডার এলোগেইছ ও ইলিয়ার এর পুরোধা। কর্ডোভার ফৌজ ঝডোগতিতে এগিয়ে আসছে। শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা লড়াই করার জন্য তৈরী। এতে অবরোধ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা এক্ষণে বলা মুশকিল। ওদের জনৈক কমান্ডার এসে আমাদের বলেছিল যারা আসন্ন অবরোধে আমাদের সঙ্গ দেবে তাদের মুক্ত করে দেয়া হবে। পক্ষান্তরে, যারা সঙ্গ দেবে না তাদের হত্যা করা হবে। মাত্র তিনজন সৈন্য ওদের এ কথায় প্রতারিত হয়েছে বাকীরা অস্বীকার করেছে। আমি ওদের চতুর্থজন। এই আশায় ওদের সঙ্গ দিয়েছিলাম যাতে পলায়নের সুযোগ পাই। মোক্ষম স্থান এটাই। তোমাদের মনে করেছিলাম প্রেতাত্মা।
প্রেতাত্মায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছি আমরা। বাদশাহদের আলসেমি আমাদের এরূপ করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মুহতারাম বুযুর্গ! এটা স্বীয় কৃতকর্মের সাজা। এখানকার প্রতিটি মুসলমান নিজকে খ্রীস্টানদের বাদশাহ বলে মনে করত এবং তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করত। নিছক মসজিদে নামায পড়াকেই আপনি ইসলাম মনে করতেন, কিন্তু মানুষের প্রতি ভালবাসা আল্লাহকে ভালবাসার-ই নামান্তর শিক্ষাটি বেমালুম ভুলে গেছেন। আপনার অজানা নয়, শাসিতের প্রতি অবজ্ঞা একদিন শোষককেই ভোগ করতে হয়। শোষিতের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতেই থাকে। ওই আগুনে একদিন শোষককে পুড়ে মরতেই হয়। নিজেদের হাতে তৈরী অগ্নিকুণ্ডে এক্ষণে নিজেরাই জ্বলে মরছেন। অবশ্য আমাদের সমস্যা এখন ভিন্ন ধাচের। আমাদের ফৌজ আসছে, তাদের শহরে প্রবেশের মওকা পাইয়ে দিতে হবে। গোটা শহরবাসী লড়তে উম্মাদপ্রায়। ভেতর থেকে কোনক্রমে দরজা খুলে দিতে হবে। আমাদের বন্দী সেপাইদের হত্যা করার হুমকিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। থামলেন রায়হান। বৃদ্ধ বললেন,
আমাদের যার পর নাই কোরবানী দিতে হবে। ভেতর থেকে দরোজা খোলার মত কোন প্ল্যান তোমার আছে কি? তুমি সৈনিক, কমান্ডার। বহু অভিজ্ঞতা তোমার ঝুলিতে।
স্রেফ সৈনিক নই-গেরিলা কমান্ডারও। এই যুবতীদের সর্বাগ্রে হেফাযতে রাখা জরুরী।