উবায়দুল্লাহ! আপনার অজানা নয় বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন ফ্রান্স সম্রাট লুই। আমি এই খণ্ডদল নিয়ে ফ্রান্স ও মাদ্রিদের মাঝপথে থাকব। ফ্রান্স বাহিনী মাদ্রিদ অবরোধ ভাংতে এগিয়ে আসতে পারে। আমার বাহিনীকে টহলরত রাখব, টহল দেব খোদ আমি নিজেও।
ফ্রান্স বাহিনী এসে গেলে সামান্য বাহিনী নিয়ে আপনি ওদের প্রতিহত করতে পারবেন না। তবে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে আমাদের থেকে কমান্ডো চেয়ে পাঠাবেন।
মুসলমান হামেশা সামান্যই থাকে ও থাকবে। আমি ফ্রান্সীয়দের পথ আগলে রাখব লড়াই করব না। সৈন্যদের দলে দলে বিভক্ত করে গেরিলা হামলা শানাব। ওদেরকে হাঁকিয়ে হাঁকিয়ে ঘাম বের করে ছাড়ব। আল্লাহর উপর অগাধ আস্থা রেখে আপনি যান সেনাপতি। আল্লাহ আমাদের সহায়।
এ ছিল স্পেন অধিপতি আবদুর রহমানের প্রকৃত রূপ। তিনি যেমন সিংহাসনের যোগ্য লোক ছিলেন, তেমনি ছিলেন রণ নিপুণ জাদরেল সেনানায়ক। উচ্চজ্ঞানের মহান বিবেক দ্বারা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ফ্রান্স বাহিনী অতি অবশ্যই সীমান্তে ঘোরাফেরা করে থাকবে এবং গেরিলা আক্রমণ চালাবে। কিন্তু সংগীত আর নুপুর-নিক্কণের ঝনঝনানিতে সিংহশাবক কিছুকাল ঘুমিয়েছিলেন।
***
মাদ্রিদের যে সামান্য কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল তারা সকলেই কারাবন্দী। এদের এক কমান্ডার পলায়ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইনি কর্ডোভার ফৌজকে বিদ্রোহের খবর দিয়েছিলেন। যেদিন মাদ্রিদে কর্ডোভা বাহিনীর আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়ে সেদিন সকলের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী কমান্ডার মুসলিম বন্দী সেপাইদের বলেন, কাল নাগাদ কর্ডোভার ফৌজ এসে পড়বে আমরা কিছুতেই তাদের অবরোধ সফল হতে দেব না। ওরা শহরে কোনক্রমে প্রবেশ করতে পারলে পাইকারী হত্যাযুদ্ধ চালাবে। আমাদের সঙ্গ দেয়ার স্বার্থে তোমাদের নিজেদের জান বাঁচাতে পার। কর্ডোভা বাহিনী অবরোধ উঠিয়ে নিলে তোমাদের মুক্ত করে দেয়া হবে, তখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পার।
এটা একটি চাল। বিদ্রোহীদের প্রকৃতপক্ষে টেনিংপ্রাপ্ত দক্ষ সৈনিকদের দরকার। এরা জেলখানা থেকে জনাচারেক মুসলিম সেপাইকে রাজী করতে পারল। ওই চারজনের একজনের নাম আবু রায়হান। ইনি গেরিলা কমান্ডার। অন্যরা সাধারণ সেপাই। সকল মুসলিম ফৌজ অবাক হলো আবু রায়হানকে দুশমনের দলে ভিড়তে দেখে। এরা চলে গেল। কারার সেলে আবদ্ধ ফৌজ এদের গাদ্দার ও বুদিল বলে ধিক্কার দিল। বিদ্রোহী কমান্ডার এগিয়ে চলছে, আর এর পেছনে। এরা গলির মোড়ে এলে বুদ্ধিমত্তা বলে আবু রায়হান একটু পেছনে চলতে লাগলেন। সঙ্গীরা পর্যন্ত ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল না। আবু রায়হান পেছনে তাকাল এবং আরেক গলির মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গে। কমান্ডার কর চলার পর খেয়াল করলেন, চারজনের একজন উধাও। আবু রায়হান তখন অনেক দূরে চলে গেছেন। সূর্য ডুবছে। গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে, কর্ডোভা বাহিনী আসছে। সকলের মাঝে হতাশা।
শহরের কোল জুড়ে রয়েছে অগভীর নদী। রয়েছে বিশাল প্রাচীর ও তার নীচে খাদ। জনশ্রুতি রয়েছে যে, ওইসব খাদে ভূত-প্রেতের আনাগোনা। মানুষের আনাগোনা তাই এদিকটায় কম।
আবু রায়হান সাথীদের কাছে গেলেন না। তিনি শহর ছেড়ে বেরুতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কর্ডোভা বাহিনীর আগমনি শুনে সকল প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি শহরেও কোথাও আত্মগোপন করতে পারছিলেন না। তিনি বিরান এলাকাভিমুখী হলেন। সূর্যাস্তের পর তিনি ওই এলাকায় গেলেন। ওই খাদ-এর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার হৃদয়ে তোলপাড়। না জানি ভূত-প্রেত গলা টিপে দেয় কি-না! রাত বাড়ার সাথে সাথে তার ভীতিভাবও বেড়ে চলছিল।
আবু রায়হানের সামনে মৃত্যু বিভীষিকা। এখন বাঁচার একমাত্র পন্থা খ্রীস্টান কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং বিদ্রোহী বাহিনীর হয়ে লড়াই করা। কিন্তু এ যে তার পক্ষে অসম্ভব। হাড় কাঁপানো শীতে তার অবস্থা করুণ। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর তিনি একটি গবরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
***
যবানে তার খোদার নাম। বার বার উচ্চারণ করছিলেন কোরআনের আয়াত। নির্জন গুহায় কেননা সাড়াশব্দ নেই। ভয়াল কোনো ভূত-পেতিরও দেখা নেই। গুহার দেয়ালে ধূলি ধূসর তৈলচিত্র, কোথাও অশ্বথবৃক্ষের শেকড় দাঁত বের হাসছে। আলোহীন মোট পরিবেশ। শিরশির হিম বাতাসের হিন্দোলে তিনি গুহার আরো ভেতরে প্রবেশ করেন। আচমকা মানবশিশুর আর্ত চিৎকারে তার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। আবু রায়হান ব্যাপারটা আঁচ করার চেষ্টা করেন। তার সামনে এখন শহর থেকে বের হওয়াই মূল সমস্যা নয়- সমস্যা জান বাঁচানোরও।
নির্জন গহ্বরের অভ্যন্তরের এই চিৎকার ও ফিসফিসানি তাকে দুঃসাহসী করে তোলে। তিনি উচ্চস্বরে সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত করতে থাকেন। ভেতরে একটি করিডোর দেখতে পান। ওখানে থেকে সামান্য বামে ফোপানো কাঁদার সুর ভেসে আসে। মনে হচ্ছে, ভূত-প্রেত তাকে গ্রাস করতে আসছে। এই বুঝি ছোঁ মারল। ঠিক এ সময় পেছন থেকে কারো লঘু পদধ্বনি কানে আসে। ভূত ছাড়া এই ভৌতিক কর্মকাণ্ড আর কার? আবু রায়হান বড় সাহস করে সামনে এগোল, পেছনে সরার উপায় নেই। কেননা পেছনে কারো আগমন ঘটছে। বাচ্চার চিৎকার আচমকা থেমে গেল। নারীর সানাদায়ক ছেলে ভুলানো কথা কানে এলো। আবু রায়হান এ সময় মৃত্যু হাতের মুঠোয় পুরেন। রিক্তহস্ত তিনি। বিদ্রোহীরা তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। মনে মনে বলেন, গোটা ব্যাপারটাই ভূতুড়ে। ওদেরকে বলব, আমি চোর-ডাকু নই। আল্লাহর সেপাই। আল্লাহর নামে লড়ি। আমি কাফেরদের বন্দীশালা থেকে ভেগে এসেছি। ওদের সামনে আসমর্পণ করিনি।