নারীর মধ্যেও এ ধরনের স্ববিরোধী সমোহনী শক্তি বিদ্যমান। নারী যেমন খাপ ছিঁড়ে তলোয়ার বের করে প্রিয়জনের হাতে তুলে দেয়, তেমনি নাঙ্গা তলোয়ারও অনেক সময় খাপে ঢুকাতে বাধ্য করে। আমি নারীর
এ দুটি রূপই দেখেছি। মোদাচ্ছেরাই আমার হাতে তলোয়ার তুলে দিয়েছিল। আর আপনার তলোয়ার খাপে ঢুকিয়েছিল কে?
আবদুর রহমান চকিতে উবায়দুল্লাহ দিকে তাকালেন। তাঁর চিন্তাজগতে কেমন যেন চমক লেগে গেছে। তিনি আনমনা হয়ে গেলেন। এই প্রশ্ন তার কাছে প্রত্যাশিত নয়। তিনি যেন সহসাই নিজকে সংযত করে নেন। উবায়দুল্লাহ তাঁর পরিবর্তন দেখে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। আমীরের চোখে এ সময় ভেসে ওঠে কর্ডোভার রাজপ্রাসাদ যেখানে যিরাব ও সুলতানার রূপের ঝিলিক। উবায়দুল্লাহ মাদ্রিদ অবরোধের প্ল্যান নিয়ে কথা শুরু করলেন। তিনি দেখলেন, আবদুর রহমানের ভেতরের স্পন্দন ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। মাদ্রিদ নিয়ে তিনি উচ্চাশা পোষণ করলেন।
মাদ্রিদ তখনও বেশ দূরে। ফৌজ চলছে লাগাতার। যাত্রা বিরতি দরকার।
***
মাদ্রিদের খানায় ইবনে আবদুল জব্বারের কালো গ্রাস। তিনি রীতিমত মাদ্রিদের স্বাধীন গভর্নর হয়ে গেছেন। নও মুসলিমরা ইসলাম ছেড়ে খ্রীস্টান ধর্মে ফিরে গেছে। এলোগেইছদের মিশনের এটা প্রথম সাফল্য। নও মুসলিম দ্বি-চারী মনোভাবই এই সাফল্যের মূল কারণ। এলোগেইছ ও ইলিয়ার মাদ্রিদেই ছিল। তাদের ফৌজি পরিসংখ্যান ৪০ হাজারের ওপরে। মাদ্রিদ দখল করতেই এই সংখ্যার সাথে আরো ১৫ হাজার যোগ হয়। অবশ্য এরা সুদক্ষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত নয় আদৌ। সকলেই শহুরে। একক লড়াই জানত। সৈনিকদের মত দলবদ্ধ লড়াই জানবে কোত্থেকে। খুব সহজেই তাদের অভ্যুত্থান নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল। বিজয়োৎসবে তাই তারা বিভোর। মুসলিম ঘর-বসতি তখন জ্বলন্ত ছাই-ভয়ে রুপান্তরিত। প্রিয়জন কোথায় কি হালে আছে তাও অনেকের জানা ছিল না।
মাদ্রিদের কেন্দ্রস্থলে বিশাল এক ময়দানে ঘোড়দৌড় ও ফৌজি মহড়া হত। বিদ্রোহী লিডারদের আমন্ত্রণে জনগণ ওই রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হলো। খানিক পর মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার, এলোগেইছ ও ইলিয়ার ঘোড়ায় চেপে সেখানে এলো।
এলোগেইছ সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে জ্বালাময়ী ভাষণ রাখিল :
মাদ্রিদ বিজয়ী বীর জনতা হে। অভূতপূর্ব বিজয়ে তোমাদের মোবারকবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার। মাদ্রিদের গভর্নর, সুলতান কিংবা আমীর যাই বল না কেন, সে এক্ষণে তোমাদের সামনে। সমবেত জনতা ইবনে আবদুর জব্বার জিন্দাবাদ, ঈসা মসীহ জিন্দাবাদ নারা লাগাল। স্পেন আমাদের আমরা স্পেনের। হাজার জনতার গগন বিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস মুখরিত। খ্রীস্টান মহিলারাও ওখানে এসেছে। তারা একে অপরের বুকে মিশে যাচ্ছে। এতে নগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
জনতার তুমুল করতালির মধ্যে এলোগেইছ বলে চলেছে, বন্ধুরা আমার। আমীর ইবনে আবদুর জব্বার প্রমাণ করেছেন ধর্মের কোন গুরুত্ব নেই মানব জীবনে। তোমাদের মুক্তির স্বার্থে তিনি হুকুমত ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তোমাদের হাতে মাদ্রিদের পতন ঘটেছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন কর্ডোভাও তোমাদের হাতে চলে যাবে। তবে এর জন্য তোমাদের চরম কোরবানী দিতে হবে।
আচমকা জনৈকা ঘোড়সওয়ার কাতার চিরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। তার চোখে-মুখে ভীতির ছাপ। বক্তারা তার কথা শোনার পর এলোগেইছ আবারো জনতার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াল।
মাদ্রিদের বীর বাহাদুরগণ! তোমাদের আত্মত্যাগের মুহূর্ত আসন্ন। এইমাত্র জানতে পারলাম, স্পেনের গভর্নর মাদ্রিদ অভিমুখ ধেয়ে আসছেন। শহরের প্রবেশদ্বার ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও। যার যা আছে তাই নিয়ে শহর রক্ষা প্রাচীরে উঠে যাও। তীর-পাথর মেরে দুশমনের গতিরোধ কর। অনবরত নারা আর দুয়োধ্বনির মাধ্যমে দুশমনকে অভিনন্দন জানাও। খেয়াল রেখো, কর্ডোভা বাহিনী যেন প্রাচীরের কাছেও ঘেঁষতে না পারে। ভয় পেয়ো না। আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য-রসদ রয়েছে। আমরা ভাতে মরব, পানিতে মরব তবুও দুশমনকে শহরে প্রবেশ করতে দেব না।
মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, মাদ্রিদের ব্যাঘ্র সন্তান! বিজয় তোমাদের পদচুম্বন করবেই, তবে এবারে তোমাদের টক্কর হবে সুদক্ষ সুশিক্ষিত কর্ডোভা বাহিনীর সাথে। আবদুর রহমান বাহিনী কেল্লা পতনের কৌশল জানে। তোমরা নিছক নারা ও দুয়োধ্বনি দ্বারা তাদের পরাভূত করতে পারবে না। তবে ওদের পরাজিত করা অসম্ভব নয়। তোমরা হতাশ হবে না। দুশমন যেদিক থেকে চড়াও হতে চাইবে সিংহশাবক সেদিক থেকেই তীরবৃষ্টি বর্ষণ করবে। মনে রেখো, সুযোগ তোমাদের এই প্রথম এবং শেষ। জিতলে বেঁচে গেলে আর হারলে নির্ঘাত করুণ পরিণতির শিকার হবে তোমরা। কর্ডোভা বাহিনী ভেতরে ঢুকলে যে বিভীষিকা সৃষ্টি হবে তা তোমাদের কল্পনারও বাইরে। ওরা আমাদের ফৌজ। ওদেরকে জানি আমি। শাস্তি দেয়া শুরু করলে ওদের অন্তর পাথর হয়ে যায়। পাইকারী হত্যার সম্মুখীন হবে তোমরা। তোমাদের যুবতী মেয়েদের কর্ডোভা বাহিনীর বিমায় নিয়ে যাওয়া হবে। যে আযাদী তোমরা হাসিল করেছ তার মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করো, সংরক্ষণ করতে ব্যাপৃত হও।
জনতার উৎসাহ এই জ্বালাময়ী বক্তৃতার পর বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। চারদিকে কেবল স্লোগান। এলোগেইছ, ইলিয়ার ও মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার যোগ্য লোক বেছে বেছে নড়াইয়ের স্কীম বানাতে লেগে গেল। আবদুর রউফ ও মূসা ইবনে মূসার বাহিনী টর্নোডো গতিতে ধেয়ে আসছিলেন। তিন দিনের দূরত্ব তারা দুদিনে অতিক্রম করলেন। কিছু বাহিনী আলাদা করে আবদুর রহমান পথিমধ্যে সাময়িক যাত্রাবিরতি করলেন। তিনি উবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে কিছু সেনা মাদ্রিদ রওয়ানা করে বললেন,