***
মধ্যরাত।
মাদ্রিদ ঘুমিয়ে গেছে।
ঘুমিয়ে গেছে আরব্য মুসলিম নিজ বাসভবনে।
কিন্তু বিদ্রোহীরা বিদ্রি। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার সাধুবেশে শহরে পৌঁছে গেলেন। ওই সময় পর্যন্ত তার অধীনে ৪০ হাজার ফৌজ ছিল। যাঁর সিংহভাগই শহরের বাইরে। বাদবাজ সামান্য মাদ্রিদে।
গভীর রাতের সূচিভেদ্য অন্ধকারের বুকে গভর্নর হাউজের সামনে হাজারো মশালের আলোতে নারা ধ্বনি শোনা গেল। আমীরে গভর্নরের বডিগার্ডরা ঘুম ভেঙ্গে পরিস্থিতি আঁচ করারই সুযোগ পেল না, প্রতিরোধ তো পরের কথা। গভর্ণর চোখ মেলে দেখলেন তার সম্মুখে আট দশ জন সশস্ত্র সেপাই। সকলের হাতে নাজা আসি। তারা তাকে উঠিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরে বিদ্রোহী জনতার গগন বিদারী চিৎকার। ঘোড়ার হ্রেসাধ্বনি। মুসলমানদের ঘরে আগুন। চলছে লুটতরাজ সেখানে সমানে। আমীরে মাদ্রিদ চিৎকার দিয়ে বলেন, দেহরক্ষীরা কৈ? এগুলো হচ্ছে কি?
তোমার আগেই তাদের জেলে পুরা হয়েছে জনৈক বিদ্রোহী বলল, তোমার বাহিনীকে নিরস্ত্র করে আশে পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এর নাম অভ্যুত্থান। তোমার নেতৃত্ব শেষ। এখন তুমি গর্ভনর নও-আমাদের বন্দী।
তাকে এক আলীশান মহলে নেয়া হলো। যেখানে ঝাড়বতি জ্বলছে। ওখানে এক লোককে দেখে তিনি চমকে উঠলেন। বললেন,
তুমি! মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বার? আমার থেকে জবাবদিহিতার সময় শেষ। তোমার গোস্বা এমুহূর্তে থোক। বাকী জীবন তোমাকে জেলের ঘানি টানতে হবে।
গাদ্দার! শেষ পরিণামের প্রতি এতটা উদাসীন হয়ো না। গাদ্দার বাদশাহকে হত্যা করতে পারে, বাদশাহ হতে পারে না। কদিন নেতৃত্বের নেশা পুরে নিজের চোখেই এর পরিণতি দেখবে। যাদের কাঁধে করে এ পর্যন্ত পৌঁছেছে তারাই তোমাকে রেখে বিপদ দেখে সটকে পড়বে।
মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বারের চোখে-মুখে এ সময় ক্ষমতার নেশা। তিনি ঘৃণাসুলভ মুখে বললেন, তাকে নিয়ে যাও। বন্দী করে তার পরিবার-পরিজনকে।
ফৌজকে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। তাদের আশেপাশে বিদ্রোহীদের প্রহরা। চারদিকেই মশালের আলো। শহরে কিয়ামতের বিজষিকা। মুসলমানদের ধন-সম্পদ খ্রীস্টান মাড়োয়ারীদের ঘরে জমায়েত হচ্ছে। বাড়ীতে বাড়ীতে আগুনের লেলিহান শিখা। এ সময় জনৈক মুসলিম কমান্ডার সুযোগ বুঝে একটি বৃক্ষে চড়ে আত্মরক্ষা করেন। তিনি মাদ্রিদ থেকে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ওই বৃক্ষের নীচে পাহারাদারেরা টহল দিচ্ছে। তিনি এক সময় সুযোগ পেয়ে গেলেন। এক পাহারাদার একাকী ঘোড়ার পিঠে টহল দিচ্ছিল। কমান্ডার সহসাই বৃক্ষ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ঘোড় সওয়ারকে হত্যা করে তার পিঠে চেপে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
শহরের প্রবেশ দরোজা উন্মুক্ত ছিল। মোহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বারের যে বাহিনী শহরের বাইরে অবস্থান করছিল তারা ভেতরে ঢুকছিল। আবার ভেতরের লোকজনও বাইরে আনাগোনা করছিল। লুটতরাজের দরুন গোটা শহরে হুলুস্থল কারবার। কে কার খবর রাখে। অতি দ্রুত সে শহর থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং কর্ডোভাভিমুখী হয়। সামনে তার দূরপাল্লার পথ অথচ পৌঁছাতে হবে দ্রুত। জলদি মাদ্রিদের খবর পৌঁছানো দরকার যে, এখানে অভ্যুত্থান হয়েছে। রাতভর সফর করল সে। অবসাদ মোচনের এতটুকু সময় হয়নি তার। আঁধারের বুক চিরে সূর্য উঠে এলো। সন্নিকটে এক জোড়া ঘোড়া তার সামনে ভেসে উঠল। মনে হচ্ছে ওরা ফৌজ। দ্রুত সে তাদের কাছে গেল। জানাল মাদ্রিদ অ্যুত্থানের কাহিনী। তারা বলল,
কর্ডোভায় গিয়ে কি করবে। স্পেনের আমীরকে ফ্রান্স অভিমুখী দেখবে। তিনি সসৈন্যে ফ্রান্স আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। কোথাও যেতে হলে ওদিকেই যাও।
সওয়ারদ্বয় কমান্ডারের দিকে ও তার ক্লান্ত ঘোড়ার দিকে তাকাল। তারা সাগ্রহে ঘোভা বিনিময় করল। এক্ষণে সে একটি তাজা ফৌজি ঘোড়ার পিঠে। পদাঘাত করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটোয়। দিগন্ত প্রসারী ধূলিঝড় উড়িয়ে ঘোড়া চলে টগবগিয়ে। এভাবে এই কমান্ডারের মাধ্যমেই আমীরে স্পেন মাদ্রিদ-অভ্যুত্থানের খবর পান।
***
ফ্রান্স অভিযান স্থগিত রেখে সালার আবদুর রউফকে প্রত্যাবর্তন করতে হলো। তার গতি ছিল দ্রত। তিনি মাদ্রিদ থেকে খুব একটা দূরে ছিলেন না। এদিকে আবদুর রহমানও ছুটছেন মাদ্রিদমুখো। তিনি সহসাই রণসঙ্গীত বাদকদের মাঝে এনে বাদ্য বাজালেন। সঙ্গীত বাদকরা বলল, আলীজাহ! আমরা রক্ত উত্তেজক বাদ্য বাজাব। আমাদের বাজনায় ঘোড়ার পর্যন্ত জোশ-জযবা বাড়বে। বাদকদল উত্তেজনাকর বাজনা শুরু করল। পুরো ফৌজে তখন প্রতিশোধের আগুন।
আবদুর রহমান যা চাচ্ছিলেন তাই-ই হলো। আবদুর রহমান যেন শরীর থেকে দূষিত রক্ত বের করে ভাল রক্ত ভরে দেন। তার দিগ্বিজয়ী চাঁদ-তারা পতাকা এভাবে উড়ছিল যাতে সৈনিকদের উদ্দীপনা বেড়েই চলছিল। ভাবখানা যেন এমন যে, তাদের সকলকে দুর্গম পাহাড় অতিক্রম করতে হবে।
আবদুর রহমান বদিকে তাকালেন। তার প্রধান সেনাপতি উবায়দুল্লাহ চলে যাচ্ছিলেন। তিনি তার কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, উবায়দুল্লাহ! রণসংগীত থেকে যেদিন মুসলিম জাতি বিমুখ সেদিন থেকেই তাদের পতন শুরু।
উবায়দুল্লাহ বললেন, সংগীতে এমন সম্মোহনী শক্তি আছে যা মৃতদের জাগিয়ে তোল। পক্ষান্তরে এই সংগীতের বদৌলতে জাগ্রত মানুষও সময় বিশেষ মরণ ঘুমে বিভোর হয়ে পড়ে। এটা শিরার জমাট খুনকে যেভাবে গরম করে তোলে, তেমনি গরম খুনকেও হিমশীতল করে ফেলে। কাজেই এক্ষণে মানুষের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন ধরনের সংগীতামোদী।