স্পেন ইতিহাসে ৮২২ খ্রীস্টাব্দ ছিল সালার ওবায়দুল্লাহ, আঃ করিম, আঃ রউফ ও করনের যুগ। এরা সেই সিংহশাবক যারা দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ইবনুল হাকামকে যিরাব ও সুলতানার মোহজাল থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আব্দুর রহমান যখন ফ্রান্স অভিমুখে টর্নেডো গতিতে ধেয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাকে সেই মদ্যপ ও নারী লোলুপ মনে হয়নি, কর্ডোভা প্রাসাদে যিনি সুলতানার বাহুবন্ধনে দিনাতিপাত করতেন। তার চোখে তখন খালিদী রশ্মি, মুখে তারিকী হুংকার ও দেহে ইবনে নুসায়েরের শৌর্য বীর্য। আপাদমস্তক জুড়ে তার জেহাদী উদ্দীপনা ছিল। দেমাগে শুধু রণাঙ্গনের রক্তলাল দৃশ্য।
তিনি মাদ্রিদে আব্দুল জব্বারের অ্যুত্থান কাহিনী শুনে এতটুকু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। মনে হয় ব্যাপারটা তিনি আগেভাগেই জানতেন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেননি কোনদিনও। এটাই যোগ্য শাসকের বৈশিষ্ট্য। ফওরান ফ্রান্স যাত্রা স্থগিত ঘোষণাকরত আঃ রউফকে জানান, ফ্রান্স অভিযান থেকে ফিরে এসো মাদ্রিদে কোচ করো। আব্দুর রহমানও তার বাহিনীসহ মাদ্রিদ অভিমুখী হন।
মাদ্রিদ অভ্যুত্থান একদিনেই হয়নি, ঘটা করে হয়নি, ঈসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহী পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। ওরা আঃ জব্বারের মত নেককার ও সৎ শাসককে বদকার ও অসৎ বানিয়ে তাকে এই টোপ দিয়েছিল যে, তোমাকে মাদ্রিদের স্বাধীন সম্রাট বানানো হবে। খ্রীস্টানরা হবে তোমার জনগণ ও মদদগার। শুধু কি তাই, তাকে লোকালয় ছেড়ে নির্জন পাহাড়ের গুহায় নারী ও মদে ডুবিয়ে রাখা হয় গলা অবধি।
লাগাতার যুদ্ধের দরুন ট্যাক্স বেড়ে যাচ্ছিল। মাদ্রিদ রাজ্যে বিশেষ ট্যাক্সের মাত্রা বেড়েছিল অধিক। যদ্দরুন এই অঞ্চলের মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।
এদিকে কেন্দ্রীয় গভর্নরের বিরুদ্ধাচরণ কার দরুন আব্দুল জব্বারকে গদীচ্যুত করা হয়েছিল। খ্রীস্টানদের বিগবস এলোগেইছ ও এলিয়ার মাদ্রিদে পৌঁছে গেল। এদের মাদ্রিদ গমনকে গোপন রাখা হল। তারা গীর্জার পাদ্রিদের সেখানে একটি গুপ্ত মিটিং-এ জরুরী পরামর্শ দিল।
কাজেই এপর থেকে পাদ্রীরা তাদের ধর্মোপদেশের মধ্যে একথাও সংযোজন করল যে, ঈসায়ীদের মুসলিম জাতিতে পর্যবসিত করার জন্য ট্যাক্সের ভারবাহী বোঝা চাপানো হচ্ছে। ঈসায়ীরা এই বোঝা কবুল করে এর তলে পিষ্ট হতে হতে একসময় ভিক্ষুকের জাতিতে পর্যবসিত হবে এবং একদিন ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হবে। আর কেউ বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলে সে হবে মুসলমানদের দাস, সুতরাং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় একটাই-কর্ডোভাকে ট্রাক্স দেয়া বন্ধ করো। গীর্জার অফিসার ও কর্মচারীদের জানিয়ে দেয়া হলো, যে কোন শ্রেণীর লোকদের জন্য দরজা উন্মুক্ত করো। সবাইকে বলো, কর্ডোভাকে ট্যাক্স না দিতে। ইতোমধ্যে আঃ জব্বার ষড়যন্ত্র করে কেন্দ্রের ট্যাক্স উসূল কারীদের হত্যা করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রিদের ট্যাক্স অর্ধেক মওকুফ করে দিল। বলল, এখন থেকে আমার লোকজনই ট্যাক্স আদায় করবে।
নিহত ট্যাক্স উসূলকারীদের দাফন করে দেয়া হলো। তারা ফিরে না যাওয়ায় তালাশ শুরু হল, কিন্তু কোন হদিস করা গেল না। কানাঘুষার মাধ্যমে ছড়ানো হলো, তাদেরকে দেশের অন্য কোথাও দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত জানা গেল আঃ জব্বার ট্যাক্স উসূল শূরু করে দিয়েছে, কিন্তু তারওতো কোন খোঁজখবর নেই, তার দ্বারা জনগণ উপকৃত হচ্ছিল। কাজেই তার সন্ধান দিতে কেউই তেমন একটা আগ্রহ দেখালো না।
এলোগেইছ শহর-বন্দরে ঘুরে ঘুরে মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প হড়াতে ব্যাপৃত হল। বলে বেড়ালো, আব্দুল জব্বারই আমাদের শাসক। মাদ্রিদ স্বাধীন রাজ্য। সুতরাং এখন প্রতিটি খ্রীস্টানকে সেটাই মনে করতে হবে। মাদ্রিদের বর্তমান গভর্নর এক্ষণে আমাদের হাতে বন্দী। কিছুদিনের মধ্যে কর্ডোভা বাহিনী আসবে। লড়াইতে নামতে হবে সকলকে, ওদের মোকাবেলা করতে হবে। স্পেনকে মুসলিম মুক্ত করার অভিযানের এইতো সময়।
জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে আবুল জারের পতাকাতলে শামিল হতে লাগল। এক রাতে ডঙ্কা পিটিয়ে ঘোষণা করা হলো, সকালে রণসংগীত বাজতেই সকলে সশস্ত্র ঘর থেকে বের হবে এবং গভর্নর হাউজে চড়াও হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
মাদ্রিদের আমীর আবদুল জব্বার সম্পর্কে জানা গেল, মানুষের থেকে ট্যাক্স উসূল করে তিনি অন্তর্ধান হয়ে গেছেন, কিন্তু তিনি জানতেও পারলেন না যে, মাদ্রিদের খ্রীস্টানরা সৈনিক হয়ে গেছে। মাদ্রিদ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। যে কোন সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। রাজ্যটা ছিল না খ্রীস্টান অধ্যুষিত। নও মুসলিমরা পর্দার আড়ালে খ্রীস্টানদেবই আজ্ঞাবহ ছিল। আরব অধিবাসীরা ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারা শহরের পরিস্থিতি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না।
ইতিহাসের পাতা নীরব ভাষার বলে চলেছে, আরব থেকে আগত মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে নিজদেরকে বাদশাহ ভাৰা শুরু করে দিল, তারা খ্রীস্টান আবাসন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসবাস করত এবং এদেরকে ঘৃণা করত দুর্ব্যবহার করত। এজন্য নও মুসলিমদের হৃদয়ে ইসলাম স্থান করে নিতে পারেনি। ইসলামের সৈনিক হওয়ার স্থলে তারা ঈসায়ী হয়ে ওঠে। মুসলমানদের ওই অদূরদর্শীতার ফল হলো এই যে, খ্রস্টানরা যখন কোনো ষড়যন্ত্র করেছে, দেখার মত কেউ ছিল না তখন। কাজেই ভূগর্ভস্থ ওই ষড়যন্ত্র তাদের অজ্ঞাতসারে করা গেছে সহজেই। গভর্নরদের গোয়েন্দা বিভাগ এতই সংকুচিত ও চিলাচল ছিল যে, শহরের কোনো খবরাখবর তারা রাখতে পারত না। ওখানে ছিল স্রেফ গভর্নরের সামান্য বডিগার্ড, সামন্য কিছু ফৌজ।