এই বাহিনী যখন কর্ডোভা ছাড়ছিল তখন দ্রুতগামী একটি ঘোড়া দূরপাল্লার উদ্দেশ্যে লাগাম কষল। এই ঘোড়ার গন্তব্য মাদ্রিদ। সুলতানা ও হেরেমের রমণীগণ উঁচু মহলে দাঁড়িয়ে এদের চলে যাবার দৃশ্য দেখছিল। শহরের হাজারো নারী-পুরুষ খোদমস্ত সৈনিকদের দিচ্ছিল প্রাণঢালা আল-বিদা।
এদিকে সুলতানা যিরাবকে তখন বলছে, লোকটা সময়মত কি পৌঁছুতে পারবে?
তাতো বটেই। যিরাব বলল।
আবদুর রহমানকে এই যুদ্ধে মোদাচ্ছোই উদ্বুদ্ধ করেছে। আবদুর রহমান এখনো তার প্রভাবে প্রভাবিত। আমি ওকে বাঁচতে দেব না।
বুঝে শুনেই পদক্ষেপ নাও সুলতানা আবদুর রহমান আমাদের প্রতি সন্দিহান হন৷ এমন কোন কাজ করতে যেও না। তুমি এখনো আবিষ্কার করতে পারনি আবদুর রহমান চিজখানি কি! চিন্তা করো না। অর্ধেক পথ থেকে তাঁকে ফিরে আসতে হবে।
ঘোড় সওয়ার মদ্রিদের উদ্দেশ্যে ছুটছে। যিরাব তাকে রওয়ানা করিয়েছে। মাদ্রিদে আঃ জব্বার তখন একটি একক শক্তিতে রূপ নিয়েছে। হাজারো ঈসায়ী তার দলে ভিড়েছে। নও মুসলিমের সংখ্যাও কম না।
রাতের বেলা ঘোড়সওয়ার পৌঁছে গেল। সে বিদ্রোহীদের জানাল আবদুর রহমান ফ্রান্সে হামলা করতে রওয়ানা হয়ে গেছে। আবদুর রহমানের অগ্রাভিযান খুবই গোপনীয় ছিল। কিন্তু যেখানে চাটুকার থাকে সেখানে তারা আস্তিনের সাপের ভূমিকা পালন করে।
পনেরো দিনের ব্যবধান সালার মূসা ইবনে মূসা ও আবদুর রউফ পরিকল্পিত ময়দানে গিয়ে ছাউনি ফেলেন। ওদিকে আবদুর রহমান তখনও ফ্রান্স থেকে দূরে। এ সময় মাদ্রিদের জনৈক কমান্ডার তার কাছে এসে খবর দেন, আঃ জব্বার মাদ্রিদে হামলা। করে বসেছে এবং সে এখানকার গভর্নরকে গ্রেপ্তার করেছে। খ্রীস্টানরা লুটপাট শুরু করে দিয়েছে। এখানে ওখানে আঃ জব্বারের শাসন চলছে।
আবদুর রহমান ফ্রান্স অভিযান মুলতবি করতে বাধ্য হলেন। দ্রুত এক ঘোড়ায় জনৈক দূত মারফত আঃ রউফের কাছে পাঠিয়ে বললেন, মাদ্রিদে পৌঁছুতে এবং এ শহর অবরোধ করার নির্দেশ দেন। তিনি নিজ বাহিনীসহ ফ্রান্সের দিন ধাবমান বাহিনীর গতি মাদ্রিদ্রের দিকে ঘোরান। সিংহশাবকদের দংশন শুরু করে স্পেনের কালনাগিনী।
২.১ দ্বিতীয় খণ্ড – কালনাগিনী
দ্বিতীয় খণ্ড – কালনাগিনী
মাদ্রিদের পথে
ক্রুসেড যুদ্ধ সেদিনই শুরু হয়েছিল, যেদিন থেকে গীর্জা অনুভব করল যে, কুশদণ্ডের ওপর চাঁদ-তারার ছায়াপাত শুরু হয়েছে। এ ঘটনা সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর যুগের বহু পূর্বের। উত্তাল তরঙ্গময় নোম সাগর পাড়ি দিয়ে ইসলাম গীর্জার জগতে প্রবেশ শুরু করলে কুশপূজারীরা খড়গহস্ত হয়ে ইসলামকে নাস্তানাবুদ করতে ময়দানে নামল। ওই যুগে যে কোন লড়াইকে দুরাজার লড়াই বলা হোত। পরে দুধর্মের লড়াইতে রূপ নিত। রূপ নিত দুটি পারস্পরিক আকীদার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের।
মুসলিম জাতি সর্বদা আল্লাহ ও তলোয়ারের ওপর ভরসা করে আসছে। সর্বদাই সমরবিদ্যা ও জেনারেলশিপ অবলম্বন করেছে, ময়দানে কারিশমা দেখিয়েছে। অল্পসংখ্যক সৈন্য জঙ্গী চাল, গেরিলা টেকনিক এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার দরুন বিশাল বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছে। পরে বিজিত এলাকায় তলোয়ার খাপে, ঢুকিয়ে একনিষ্ঠতা ও প্রেম-প্রীতিবলে মানব হৃদয় জয় করেছে।
খ্রীস্টান ধর্মগুরু ও রাজাগণ মুসলমানদের ক্রমাগত বিজয় দেখে যুদ্ধের পাশাপাশি অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করেন। এগুলো সবই গুপ্ত কৌশল ও নারীঘটিত। ঐ যুগে যদিও মনোবিজ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল না তথাপিও মানুষের বুদ্ধি, মেধা ও জ্ঞান-গরিমা কম ছিল না। মানব জীবনের দুর্বল ও স্পর্শকাতর দিকগুলো তারা চিহ্নিত করতে পারতো। এমনই কিছু দিক হচ্ছে গদীলোভ, নারী সুষমা ও অর্থ টোপ। গীর্জা নারী সুষমাবলে মুসলিম সরকার, মন্ত্রী ও সেনানায়কদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে। সর্বোপরি তারা মুসলিম সমাজে আত্মঘাতী গাদ্দারও সৃষ্টি করে।
মুসলিম জাতির প্রাণঘাতী চরম দুশমন ইহুদী চক্রও এসময় খ্রীস্টশক্তির এসব গুপ্ত কৌশলে হিস্যা নেয়। ইহুদীদের ইতিহাস শয়তানি আর সন্ত্রাসের ইতিহাস। খ্রীস্টান শক্তিকে এরা হেন কোন সন্ত্রাস নেই মুসলমানদের মোকাবেলায় যা করতে শেখায়নি। তাদের ভুবন মোহিনী যুবতীদের দিয়েও সাহায্য করে। ইহুদী নারীদের সম্মোহনী কৌশলে সফলতা দেখে শেষ পর্যন্ত খ্রীস্টানরাও তাদের নারীদের নিয়োগ করে এ কাজে। শুধু কি তাই! ইসলামকে নাস্তানাবুদ করতে তারা কোরআন-হাদীসের গবেষণা শুরু করে। এমন কি মসজিদে পর্যন্ত ইমামতি শুরু করে। ইসলাম খেদাও অভিযানে ক্রুসেডাররা আত্মদানও করে। ইসলামের ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে খ্রীষ্টধর্মের স্থিতিশীলতায় তারা যা করেছে তা সত্যিই প্রশংসাই। পক্ষান্তরে অদূরদশী মুসলিম শাসকবর্গ নিজেরা ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে কলহে লিপ্ত হয়। বেশ কিছু সেনানায়ক ক্ষমতার মোহে গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত লাগিয়ে দেয়। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ দুর্বল প্রতিপক্ষকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে। তারা রণাঙ্গন ছেড়ে সিংহাসনমুখী হয়। পরিণতিতে যা হবার তাই হয়। শাসনকার্যে। সিংহশাবক অদক্ষ এসব নীল ভ্রমরদের কারণে রাজনীতি দেউলিয়াত্ব রূপ ধারণ করে। যাদের একটু-আধটু প্রজ্ঞা ছিল তাও নিঃশেষ করে দেয় চাটুকাররা। এরা রাজাদেরকে বিশ্বাধিপতি করে তুলছিল। এতদসত্ত্বেও ওই যুগে এমন কিছু সিংহশাবক ছিল যাদের আত্মোৎসর্গের দরুন স্পেনে দীর্ঘ ৮০০ বছর ধরে হেলালী নিশান পতপত করে উড়ছিল। টিমটিম করে হলেও এদের বদৌলতে এখানে হকের আলো জ্বলছিল। এরা আজ অতীত ইতিহাসের নিঝুমপুরীতে এভাবে বিলীন যে, খুব তত্ত্ব-তালাশ না করলে কাউকে উদ্ধার করা যায় না। চটি বই, ক্ষুদ্র পুঁথি ছাড়া তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সত্যিই এটা ইতিহাস বিমুখ জাতির এক বেদনাদায়ক দিক।