আবদুর রহমান আড়চোখে মোদাচ্ছেরার দিকে তাকাল। মোদাচ্ছেরাকে এই মুহূর্তে সুলতানার চেয়ে ভাল্লাগছে তার কাছে। মোদাচ্ছেরা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন। আবদুর রহমান খামোশ হয়ে বসে। মোদাচ্ছেরা কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন, হাতে তার কোষবদ্ধ তলোয়ার। কোষ থেকে তলোয়ার বের করলেন। এগিয়ে দিলেন তলোয়ার স্বামীর দিকে। বললেন,
শুকে দেখুন! চোখ মেলে তাকান। এতে পাবেন সে সব কাফেরদের রক্তঘ্রাণ যারা অবশ্যই আল্লাহর দুশমন ছিল। এই তলোয়ারের চমকে দেখতে পাবেন সেই কেল্লাগুলো, এর ধারের কাছে যা পরাভূত হয়েছিল। ভোতা হয়নি এ তলোয়ার, মরচে ধরেনি। আপনার মাথা নীচু কেন রাজন?
তুমি শোননি এই লোক কি বলে গেল আমাকে? আবদুর রহমান বললেন।
ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে হুংকার মারার জন্য যতটুকু ঝাঁকুনি দেয়া দরকার ততটুকু দিয়ে গেলেন তিনি। তার প্রতিটি শব্দ শুনেছি আমি। প্রেমের দোহাই পাড়ব না, কেননা বহু নারীই ওই জিনিষটায় ভাগ বসিয়েছে। অবশ্য ওই দু অবোধ শিশুর দোহাই পাড়ব যারা আমার কলজে ছেঁড়া ধন। ওদেরকে সেই সবক দিন যা ওর দাদা-পরদাদারা আপনাকে দিয়েছেন। বনি উমাইয়াদেরকে আজকাল সেনাপতি ও ইসলামী বিজেতা হন্তা নামে খেতাব দেয়া হচ্ছে। আপনি ওই কালো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবেন না।
মোদাচ্ছেরা তলোয়ারখানা তার ক্রোড় রাখলেন। দুহাতে মাথা রেখে স্বামীর চোখে চোখ রাখলেন তিনি।
কিন্তু তার উদ্দেশ্য কি? আজকাল হলো কি, যে-ই আমার কাছে আসে টেরা কথা জানিয়ে চলে যায়; বললেন আবদুর রহমান।
গোথ একটি প্রকাণ্ড শক্তিরূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। ফ্রান্স সম্রাট লুই তাকে মদদ করছেন। আপনার মাদ্রিদে বিদ্রোহের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
কে বলছে তোমাকে এ কথা?
তাদের থেকে, যাদের কথা আপনি শুনতে চান না।
তাহলে আমার কাছে এসব কথা এতদিন লুকিয়ে রেখেছে কে?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। দিলে আপনি আমাকে আস্ত রাখবেন না। আপনি বলবেন, মোদাচ্ছেরা! তুমি সামান্য এক বাদী বৈ তো নও! সামান্য এক নারী। রাজপ্রাসাদের আভিজাত্য থেকে নিশ্চয়ই নিজকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে দেবে না। আপনার হৃদয়ে এখন থেকে এই তলোয়ারের প্রেম হওয়া চাই। শুধু এই তলোয়ারের।
আবদুর রহমান হাতে তরবারী ধারণ করলেন। ভালভাবে ওটি পর্যবেক্ষণ করলেন, মোদাচ্ছিরা একপাশে খামোশ হয়ে দণ্ডায়মান। তার চেহারার রঙে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। তিনি আচমকা উঠে দাঁড়ান এবং দারোয়ানকে ডেকে পাঠান বলেন, প্রধান সেনাপতিকে তার অধীনস্থ সালারদের নিয়ে আমার সাথে জলদি দেখা করতে বল। মোদাচ্ছেরাকে বললেন, তুমি এখন যাও।
সালারগণ এসে সম্মেলন কক্ষে জমায়েত হলেন। আবদুর রহমান ফুঁসছেন সিংহ শাবকের ন্যায়। কালকের আবদুর রহমান আর আজকের আবদুর রহমানের মধ্যে বিরাট ফারাক। তিনি সিংহাসনের সামনে এভাবে পায়চারী করছিলেন যেন কোন বিশ্ববিজেতা পায়চারী করছেন। সিংহ যেমন শিকারের দিকে তাকায়, সালারদের প্রতি সেভাবে তাকালেন বনি উমাইয়ার এই সিংহশাবক। সালারদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। হুংকার মারেন তিনি,
সেনাপতি উবাইদুল্লাহ! ফ্রান্স সীমান্তের অবস্থা আমাকে বলুন! আর বলুন ফ্রান্সে হামলা করলে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হওয়া লাগবে।
সিদ্ধান্ত নিলে কোনই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। অবস্থাদি পর্যালোচনা করলে ফল এই দাঁড়ায় যে, আমাদের সামান্য মহড়া করতে হবে। বলে সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ফ্রান্সের অবস্থাদি তুলে ধরেন। আবদুর রহমান ও অন্যান্য সালাররা অনেক কিছু অবগত হতে পারলেন। এরপরে আবদুর রহমান এমন ফরমান জারী করলেন যাতে সকলেই চমকে ওঠেন। আবদুর রহমান বললেন, আমরা ফ্রান্সে হামলা করব। ফেত্নার উৎস গিরির মুখ আমি মূলোৎপাটন করবোই।
সালারদের বিস্ময় মুচকি হাসিতে রূপ নেয়। কেননা তারাও তো সিংহের বাচ্চা এক একটা। এই ফরমান শোনার অপেক্ষায় ছিলেন তারা অধীর আগ্রহে। আব্দুর রহমান তাদের যুদ্ধের বিভিন্ন দিকের পরামর্শ দিয়ে কথা শুরু করেন। বলেন?
যে বাহিনী ফ্রান্সে হামলা করবে, তাদেরই একদল মূসা ইবনে মূসার নেতৃত্বে গোখমুর্চের দিকে কোচ করবে। আরেক দল সালার আবদুর রউফের নেতৃত্বে ফ্রান্স সীমান্তের দিকে রওয়ানা হবে। আবদুর রউফ বিক্ষিপ্ত হামলা করবে যাতে ওরা বুঝতে পারে আমাদের হামলা সীমান্তেই সীমাবদ্ধ। আমি নিজেই আপনাদের সাথে যাব আমার সাথে উবাইদুল্লাহ, আব্দুল করিম আর করনের কাহিনী থাকবে। আমি ঝড়োগতিতে ফ্রান্সে হামলা করব, পরে গোটা স্পেন বাহিনী আমার সঙ্গ দেবে। এই অভিযান থেকে ফারেগ হয়ে আমি অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভাঙব। সর্বাগ্রে বিদ্রোহীদের উৎসগিরি চুরমার করা দরকার, এটাকে আমি ইসলামের চূড়ান্ত লড়াই মনে করি।
সালারগণ এই প্ল্যানকে খুব পছন্দ করলেন। কেউ কেউ সামান্য পরামর্শ দিলেন। সকলের ঐকমত্যে অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যাতে বোঝা গেল, ফ্রান্স অচিরেই ইসলামী সাম্রাজ্যভুক্ত হতে যাচ্ছে।
***
আবদুর রহমানের প্ল্যান মোতাবেক সেনাবাহিনী রওয়ানা হলো। গন্তব্য পৌঁছুতে কম করে হলেও বিশ দিন দরকার। সালার মূসা ইবনে মূসা ও আবদুর রউফ আগে ভাগেই মূল বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে যান। দিনদুয়েক পর আবদুর রহমানও তাঁর বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করেন।