এমন কোন বিষয় থেকে তোমাদের অভয় দিচ্ছি না, খোদ আমি নিজেই যে ব্যাপারে ভীতসন্ত্রস্ত। এমন সরেযমীনে তোমাদেরকে শত্রুর মুখোমুখি করছি না, আমি যেখানে লড়ব না। আমীরুল মুমীনুন ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক তোমাদের মত তারুণ্যের অহংকারীদের এজন্য নির্বাচন করেছেন, যাতে তোমরা স্পেন সম্রাটের জামাতা হতে পার। এখানকার শাহ-সওয়ারদের কচুকাটা করতে পারলে দেখবে খোদা ও তাঁর রাসূলের বিধান কায়েম হয়ে গেছে। যে বধ্যভূমিতে তোমাদের ডাকছি, সে ভূমির দিকে সর্বপ্রথম যাত্রী খোদ আমি-ই। দুশমন ধেয়ে এলে যাকে সর্বাগ্রে তাদের মোকাবেলায় এগিয়ে যেতে দেখবে, সে আমিই। দুশমনের রক্তে যার তলোয়ার সর্বপ্রথম স্নান করবে সে তলোয়ার আমারই। আমি শহীদ হলে তোমরা আমার অন্য কাউকে সেনাপতি নিযুক্ত করো তবুও খোদার রাহা হতে পিছপা হবো না। স্পেন বিজয় না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে না।
তারিক বিন যিয়াদ যে স্থানটিতে ভাষণ দিয়েছিলেন ইতিহাস একে জাবালুততারেক জিব্রাল্টার নামে নামকরণ করেছে।
ওই সাত হাজার মর্দে মুজাহিদ-ই আজকের স্পেনকে জয় করেছিলেন। ইতিপূর্বে রোমানরা একে জয় করেছিল তারা এর নাম দিয়েছেন হেম্পেনিয়া। পরবর্তীতে এই উপদ্বীপকে জার্মানীরা জয় করে এর আন্দালাস নাম রাখে। ৭১১ হিজরীতে তারিক বিন যিয়াদের নারা বুলন্দ হবার পাশাপাশি আযান ধ্বনি উচ্চকিত হলে এদেশকে আন্দালুসিয়া বলা হতে থাকে। বদলে যায় এর পাহাড়, নদী-নালা, খাল-বিল ও শহরের নামও। এখানকার পুরানো তাহযীব-তামাদুন বদলে এক নয়া কালচারের উন্মেষ ঘটায়। এই নয়া সংস্কৃতি মানুষকে ইসলাম ধর্মে টানতে উৎসাহ যোগায়। আলহামরা ও কর্ডোভার মসজিদ আজও কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও বন্ধ হয়ে গেছে আযান দেয়ার কষ্ঠ চিরদিনের তরে।
এই সাত হাজার মুজাহিদ ওখানকার ক্ষমতা দখল করতে যাননি, গিয়েছিলেন আল্লাহর যমীনে আল্লাহর রাজ কায়েম করতে। এঁদের কতজন শহীদ হয়েছিলেন, কতজন আজীবন পঙ্গুত্বের জ্বালা সয়েছিলেন-ইতিহাস এ ব্যাপারে খামোশ হলেও কল্পনা খামোশ থাকেনি। জ্ঞানীমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন কি পরিমাণ রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছিল। স্পেনের মাটি তাদের হাড়মাংস খেয়ে ফেলছে। এরাই তারা যারা বুকের তাজা খুন নযরানা দিয়ে দ্বীনের মশাল জ্বেলে দিয়েছিল।
***
তারিক বিন যিয়াদ একদিন এ জগতের সফর শেষ করেন। এরপর এক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে যায়। এ সময় স্পেন-তখতে এমনও শাসক আসেন যারা মন-মীনার হতে তারিক ও তার জানবার্য সঙ্গীদের চেতনা মুছে ফেলেন। যে সব আত্মোৎসর্গী মুজাহিদ কলজের ঘামে এ দেশের বৃক্ষলতাকে রক্তস্নাত করেছিল, এরা তাকে অপকর্মের কালিতে কলংকিত করে। খোদার রাজত্বের স্থলে মানবের রাজত্ব শুরু হয়। যে দরবারে একদিন আদল-ইনসাফ হতো, সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পীদের কোমর দোলানো নাচে সে দরবার রিনিঝিনি করে উঠল। চাটুকারদের ভীড়ে রাজ দরবার টইটম্বুর হয়ে গেল। আমীর-ওমরারা চাটুকারদের ভাষায় কথা বলতে লাগল।
৮২২ খ্রীস্টাব্দে এমন এক বাদশাহর মৃত্যু হল আল-হাকাম যার নাম। ইতিহাস কালের সাক্ষী, তিনি রাজতন্ত্র ও হেন জুলম নেই যা বাকী রেখেছিলেন। একদিকে তিনি যেমন জনমতের তোয়াক্কা করেননি তেমনি ধার ধারেননি তাদের জান-মাল এস্তেমালের। গদীরক্ষার স্বার্থে স্রেফ দুএকজন নয়, হাজারও জনতার খুন বহাতে ন্যূনতম কার্পণ্য করেননি তিনি। মনে চাইলে মানুষের জমি-জিরাত বাজেয়াপ্ত করতেন। তার জুলুম নিপীড়নের তালিকা থেকে দ্বীনী আলিম ও মুফতীয়ানে কেরামও বাদ যাননি। রাজতন্ত্র কায়েমের ইবলিসী নেশায় তিনি হেন যড়যন্ত্র ও কূট-কৌশল নেই যা করেননি। মোটকথা আল হাকামের যুগ ছিল জুলুম ও বর্বরতার যুগ। রাজার সংবিধান ছিল তার জিহ্বা-ই।
আল-হাকামের যুগে অর্জিত বিজয়ে আম-জনতার রক্ত বইলেও তার খান্দানের কারো ফোঁটা রক্তও ঝরেনি। তিনি জানতেন না, এদেশের প্রাথমিক দিকের বিজেতারা কি পরিমাণ ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিল। যেহেতু তিনি জানতেন না, সেহেতু এর মর্যাদা দেননি কোনদিনও। রাজার মৃত্যু হলে পুত্র ক্ষমতার মসনদে বসে যেত। মসনদে বসতে গিয়ে কেউ এ উপলব্ধি করেন যে, এদেশ জয় করতে এসে মুজাহিদবৃন্দ তাদের রণতরীগুলোয় আগুন ধরিয়েছিলেন। তারা তাদের চেতনা হাতে কলমে বাস্তবায়িত করেই দেখিয়েছিলেন।
কোন দেশের মান-মর্যাদা বাস্তবিকপক্ষে তারা-ই দিতে জানে, যারা ওই দেশ জয় করতে বুকের খুন ন্যরানা দিয়ে থাকে। বিজিত দেশে যারা রক্তপাহীন ঝঞ্ঝাটমুক্ত শাসনের অধিকারী হয়, তারা নিজকে রাজা আর অধীনস্থদের প্রজা ঠাওরায়। দরবারে চাটুকারদের ঠাই দেয়। আর এদের দৃষ্টি কেবল নাকের ডগা অবধিই থাকে। ইতিহাস তো তাই বলে আসছে, বলছে, এমন কি ভবিষ্যতে বলবে। এরাই দেশ ও জাতির অবক্ষয়ের মাধ্যম। ওদের হাতে দেশ, জাতি ও স্বাধীনতা কিছুই নিরাপদ নয়। স্পেনের গ্রানাডা ট্রাজেডি এ ধরনের বিকারগ্রস্ত আমীর-ওমরাদের দ্বারাই হয়েছিল সেদিন।
***
আল-হাকামের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় আবদুর রহমান ৩১ বছর বয়সে ক্ষমতাসীন হন। ইতিহাস কালের সাক্ষী হয়ে নীরব ভাষায় বলে চলেছে, তাঁর দরবারে কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য ও বুদ্ধিচর্চার চাটুকারদের এতটা ভীড় ছিল যতটা দেখা যায়নি অন্য কোন শাসকের কালে। আবদুর রহমানের প্রাসাদ যেখানেই স্থানান্তরিত হত সেখানেই রঙ্গ-রসের আসর জমত। তিনি একদিকে যেমন তলোয়ারবাজ রণ নিপুণ ছিলেন তেমনি ছিলেন নারীর প্রতি চরম আসক্ত। মহলে তিন নারী তার জন্য প্রাণোৎসর্গী ছিল। এরা তিনজনই বাদী। এরা প্রত্যেকেই ভুবন মোহিনী কেউ কারো চেয়ে কম নয়। তম্মধ্যে একজনের নাম মোদাচ্ছেরা। আবদুর রহমান তার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে বিবাহ-ই করে ফেলেন। দ্বিতীয় জনের নাম জারিয়াহ আর শেষোক্ত জন শেফা। গান-বাজনার মুহূর্তে এরা আবদুর রহমানের পাশ ঘেঁষে বসে থাকত।