আলীজাহ! উবাইদুল্লাহ বললেন, আপনি বলেছেন, মূসার সাথে খলীফা খুবই দুব্যবহার করেছেন-এটুকু বলা যথেষ্ট নয়। বরং মূসা ও তারিক তখনও দামেস্কে থেকে দূরে ছিলেন। এ সময় খলিফার ভাই সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক উপকণ্ঠে এসে তাদের বললেন, খলীফা মুমূর্ষ। কিছু দিনের মধ্যেই মারা যাবেন এজন্য আপনারা এ মূহুর্তে দামেস্কে প্রবশে করবেন না। পরপর্তীতে দেখা গেছে গদীলোভী আরো লোক ছিল। সুলায়মান এদের মধ্যে প্রধান। তিনি মূসা ও তারিককে সাথে নিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন……………..।
মূসা তাকে বলেছিলেন, খেলাফতের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। নেই তারিকেরও। প্রত্যাবর্তনের ফরমান পেয়ে আমরা এসেছি। সুলায়মান তাকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য করার যথেষ্ট কাকুতি-মিনতি করেছেন। মূসা তাকে এই বলে চুপ করিয়েছিলেন যে, সেনানায়কদের যেমনি ক্ষমতালোভী হওয়া অনুচিত তেমনি আমিও ফৌজের মধ্যে রাজনীতি ঢুকতে দেব না। সুলায়মান এতে যার পরনাই রাগ করে চলে গেল।
মূসা ও তারিক ওয়ালিদের রাজমহলে এলেন এবং নানান তোহফা ও নগদ অর্থ পেশ করলেন। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক তখন একটু সুস্থ। তিনি বেশ খুশি হলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়েন। চল্লিশ দিন পর ওয়ালিদ ইবনে আবুল মালিক মারা যান এবং সুলায়মান তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি মূসার থেকে এমন করুণ প্রতিশোধ নেন, ইতিহাসে বনি উমাইয়াকে তা মাথা হেঁট করে দেয়। দুর্নীতি দমনের নামে তিনি মূসার বিরুদ্ধে এমন ভিত্তিহীন, আজগুবি অপবাদ আনেন যার ক্ষতিপূরণ আদায় তার পক্ষে অসম্ভব।
ইতিহাস লিখেছে, সুলায়মান মূসার প্রতি দুলাখ দীনার ক্ষতিপূরণ মামলা করেন। একজন সেনাপতির পক্ষে এই পাহাড়সম ক্ষতিপূরণ আদায়ের সামর্থ্য কৈ? সুলায়মান পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তার প্রতি বর্বর প্রতিশোধ নেন। থৈ ফোঁটা তপ্ত বালুকাপ্রান্তরে খুঁটি গেড়ে তাতে মূসাকে পিঠমোড়া বাঁধেন। আলীজাহ! জানেন তখন মূসার বয়স কত? ৮০ বছর বয়সে মূসা তারিককে নিয়ে স্পেন জয় করেছিলেন। এর প্রতিদানে ৮০ বছর বয়স্ক সালারকে খৈ ফোঁটা মরুতে বেঁধে রেখে পরে বন্দী করে রাখে। আলীজাহ! আপনার অজানা নয় মূসার এক নওজোয়ান পুত্র ছিল। নাম আঃ আজিজ। তিনিও সেনানায়ক ছিলেন। পিতার এই বর্বর আচরণের প্রতিশোধ শংকায় সুলায়মান তাকেও ফযরের নামাযের সময় হত্যা কনে। আঃ আজিজ সূরা ফাতেহা পড়ে সূরা ওয়াকেয়াহ শুরু করলে সুলায়মানের নিযুক্ত আততায়ী তাকে কূপ হত্যা করে।
এখানেই কি শেষ? বর্বর সুলায়মানের বর্বর হত্যাকাণ্ড। তিনি আঃ আজিজের ছিন্ন মস্তক জেলখানায় মূসার সামনে পেশ করেন। মূসা এর প্রতিক্রিয়ার স্রেফ এতটুকু বলেছিলেন, পাষণ্ড এমন এক সেনা নায়ককে হত্যা করল, যে দিনে যোদ্ধা ছিল আর রাতে তাহাজ্জুদ গোর। ৮০ বছরের গুপ্ত এ শোকও বরদাশত করে নিলেন।
হিজরী ৯৭ সালের হজ্জের কথা মনে করুন আলীজাহ! সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক মূসা ইবনে নুসায়েরকে তার সাথে করে নিয়ে যান পায়ে শেকল দিয়ে এবং তাকে মক্কায় গ্রাম্য ভিক্ষুকদের মত ভিক্ষা করতে বাধ্য করেন। সুলায়মান তাকে বলেন, ভিক্ষা করুন, জরিমানা আদায় করুন সবশেষে মুক্ত হোন। ওই বছর হাজীগণ খুবই উ ফুল্লচিত্ত ছিলেন। তারা একে অপরকে মোবারকবাদ দিচ্ছিলেন এজন্য যে, সম্প্রতি স্পেন সীমান্ত বর্ধিত হয়েছে। কিন্তু কারো জানা ছিল না যে, স্পেন বিজেতা ভিখারীর মিছিলে জিঞ্জিরাবদ্ধ। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমত উপচে উঠল। মদীনা মুনাওয়ারায় এসে মূসা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অপরদিকে তারিক বিন যিয়াদ গুপ্ত হত্যার শিকার হন। খলীফা সুলায়মান তাকেও নতুন কোনো যুদ্ধে যেতে দেননি।
আবদুর রহমান উঠে দাঁড়ান। পেরেশানি হালতে বিক্ষিপ্ত পায়চারী শুরু করেন। খোদার কানুন নিজ হাতে তুলে নেবেন না। আপনি ইচ্ছে করলে আমার সাথে সুলায়মানের মত ব্যবহার করতে পারেন। আমিও মুসা ইবেন নূসায়ের, মুহাম্মদ বিন কাসিম ও তারিক যিন যিয়াদের মত বিড়ম্বনার শিকার হতে পারি। তবে আপনাকে দরাজ কণ্ঠে বলছি, আমি ও আমার বাহিনী সত্য কণ্ঠ উচ্চারণে এতটুকু কুণ্ঠিত হব না। আগাম সতর্ক করে বলছি, আপনার পরিণতি খুবই ভয়াল বলে মনে হচ্ছে। বলে উবাইদুল্লাহ বেরিয়ে গেলেন। আব্দুর রহমান বড় চোখ করে উবাইদুল্লাহর চলে যাবার তাকিয়ে রইলেন।
আবদুর রহমান সাধারণ ব্যক্তি নন। তিনি বিজ্ঞ শাসক ও চৌকস। দেশ শাসনে যতটা দক্ষ তেমনি যুদ্ধ নিপুণ। উবাইদুল্লাহ জীবন বীণার সূক্ষ্ম তারগুলো ছিঁড়ে গেলো যেগুলো গুনগুনিয়ে যাচ্ছিল যিরাব ও সুলতানা। তিনি বসে গেলেন। ললাটে চিন্তায় রেখা।
***
কারো স্পর্শে তিনি চমকে উঠলেন। অঁকানো মাথা উত্তোলন করলেন। দেখলেন মোদাচ্ছেরা তার পেছনে দণ্ডায়মান। মেদাচ্ছেরা তার বাঁদী থেকে স্ত্রী হওয়া নারী। সুলতানার সাথে তার রূপের তুলনা চলে না। বড়ই ভুলিভালি মেয়ে। চেহারায় নিষ্পপের মত ছাপ। আব্দুর রহমান তাকে বিয়েই করেছিলেন। সুলতানার সম্মোহনী রূপ ও চঞ্চলতা তাকে মুগ্ধ করেছিল।
মোদাচ্ছেরা মৃদু হেসে বললেন, আপনি হেরে গেলেন কি? আপনি না সেই আবদুর রহমান, আল হাকামের যুগে যিনি কয়েকবার ফ্রান্স সীমান্তে ক্রুসেডারদের রক্তবন্যা বইয়েছিলেন? আপনি না সেই আবদুর রহমান যিনি শার্লিম্যান খ্রীস্টানকে শোচনীয়ভাবে পরাভূত করেছিলেন? শার্লিম্যান অবরোধ করলে সেই অবরোধ ভেঙ্গেছিলেন যিনি সেই আবদুর রহমান কি আপনি নন?