যিরাব ও সুলতানা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। চোখের ইশারায় সুলতানাকে বের হতে বলে সে এমনভাবে বেরিয়ে গেল যেন তার গোটা দেহে আগুন লেগে গেছে। চকিতে উভয়ের দিকে তাকালেন আবদুর রহমান, তিনি জবেহকৃত মুরগীর ন্যায় ছটফট করছেন। রাগে তিনি অগ্নিশর্মা।
উবাইদুল্লাহ! তোমার দাবী কি শুনি! স্পেনের আমীর, যাকে ইতিহাস আগামীতে স্পেন সম্রাট বলেই আখ্যায়িত করবে তার সামনে কথা বলছ- সেকথা ভুলে গেলে কি করে? আমার অন্তরঙ্গ জীবন বলতেও তো একটা জিনিষ আছে। সেখানে হস্তক্ষেপ করছ কেন?
এজন্য যে, খোদাতায়ালা আপনাকে বিশাল পৃথিবীর এক ভূখণ্ডের অধিপতি করেছেন। আমার কোনো ব্যক্তিস্বার্থ এখানে কাজ করছে না। যে মসনদে আপনি উপবিষ্ট সে মসনদে বসে কোনো আমীর রঙ্গরসের সাগরে ডুবে যেতে পারে না। পারে না সে প্রজাদের ঘামঝরা পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ কোনো গায়ক কিংবা ভ্ৰষ্টা নারীর দুপায়ে লুটাতে। পারে না উৎসব পালন করতে। অন্তরঙ্গ জীবন নিয়ে যে আমীর এটা উদ্বিগ্ন রাজমহল ছেড়ে তার বেরিয়ে পড়াই শ্রেয়।
উবাইদুল্লাহ! যা বলতে এসেছে বলো!
যে মানসিকতা আপনি পয়দা করেছেন তাতে মূল আলোচনা আসছে না। আমি বলতে এসেছি যুদ্ধের কথা। আপনি কি ফ্রান্সে আক্রমণের কথা শুনবেন? শুনবেন সেই সব বিদ্রোহের কথা যা আপনার চারপাশে আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠছে? কান দেবেন কি সেই রক্তাক্ত উপাখ্যানের দিকে স্পেনের জমিন যা বলে চলেছে?
এ কথায় প্রভাবিত হলেন আবদুর রহমান। আর যাই হোক তিনি তো স্পেনের কর্ণধার। তিনি সহসাই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন শাহী দাপটে,
ফৌজ কোথায় যাবে, কি করবে সে ফায়সালা দেব আমিই। কোনো সেনাপতিকে আমি যাচ্ছেতাই করতে দিতে পারি না। দেব না। তোমার অধীনদের জানিয়ে দাও, আমি তাদেরকে যে কোনো সময় ডেকে পরিস্থিতি আঁচ করে ব্যবস্থা নেব।
পরিস্থিতি যা তাতে আপনার এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি সেনা প্রধান। অধীনস্থ সালারদের বলব, পরিস্থিতি কি এবং ত্বরা করেই আমাদের রওয়ানা হতে হবে।
আমার হুকুম ছাড়া একজন সৈন্যও স্থান থেকে নড়তে পারে না। বললেন আবদুর রহমান।
আলীজাহ! স্বস্তির সুরে ক্ষীণকণ্ঠে উবাইদুল্লাহ বললেন, আপনি মুসলিম ইতিহাসের চাকা উল্টাতে চলেছেন। মোহাম্মদ ইবনে কাসিম হিন্দুস্তানের মত কাফেরদের দেশে আল্লাহ ও তার রাসূলের পয়গাম পৌঁছিয়েছেন। ইসলাম দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু ওই সময় সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক জ্বলে উঠলেন। জাতি খলিফার থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওই সেনানায়কের গুণকীর্তনে লেগে যায়। তিনি বিন কাসিমকে ডেকে কয়েদ করেন ও গুপ্তহত্যা করেন।
আমার হৃদয়ে এমন কোনো হিংসা নেই। বললেন আবদুর রহমান
আর স্পেনের ইতিহাসও আপনার স্মৃতিভ্রম না ঘটলে ভুলে যাবার কথা নয়। আবদুর রহমানের কথা কেটে উবাইদুল্লাহ বললেন, স্পেন উপকূলে নেমে রণতরী জ্বালানো তারিক বিন যিয়াদ এদেশ জয় করে নিলে প্রধান সেনানায়ক মূসার হৃদয়ে এই হিংসা জ্বলে উঠেছিল। তিনি তারিকের সাথে ছিলেন। তারিক অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছিল। মূসা কেবল তার গতিরোধই করলেন না বরং জবাব চাইলেন, কেন সে স্পেন ছেড়ে আরো দূরপাল্লার পথে অভিযান চালাচ্ছেন। তিনি তারিকের নেতৃত্ব কেড়ে নেন, কিন্তু তারিক তাকে বলেন, হুকুম মূসারটাই চলবে, শেষ পর্যন্ত উভয়ের সমঝোতা হয় এবং ফ্রান্স সীমান্তে গিয়ে উপনীত হন।
আমার মনে আছে উবাইদুল্লাহ! এটা আমাদের বাপ-দাদার উপাখ্যান। সবই মনে আছে।
আপনার কিছুই মনে নেই। আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি। আপনার বাপ-দাদার কি কি পদস্খলন ঘটেছিল। তারিক ও মূসা ফ্রান্স সীমান্তে পৌঁছালে দামেস্ক থেকে ওলিদ ইবনে আব্দুল মালিকের ফরমান এলো, থেমে যাও এবং দামেস্ক চলে এসো। অত অগ্রযাত্রার দরকার নেই। তিনি এদেরকে খেলাফতের হুমকি মনে করেছিলেন। মূসা বলেছিলেন তিনি প্রত্যাবর্তন করবেন না, কিন্তু তারিক বলেছিলেন, খলীফার হুকুম বরখেলাফের মত গোনাই করবেন না। তিনি চলে এলেন। মূসাও বাধ্য হলেন চলে আসতে।
পরবর্তী কাহিনী আমি জানি উবাইদুল্লাহ! খলীফা মূসার সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করেছিল এবং তারেককে গুপ্তহত্যার শিকার হতে হয়েছিল।
আবদুর রহমনের অবস্থা এক্ষেত্রে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়। তিনি যেন সেনাপতির সামনে তলোয়ার সোপর্দ করে অসহায় হয়ে পড়েছেন। সালারে আলা তাকে বাপ-দাদার অতীত কাহিনী শোনাচ্ছেন। তার কথায় তেতো ঝাঁঝ থাকলেও তা ছিল উত্তেজনাবর্ধক। উত্তেজনায় মৃদু রাগ থাকলেও এতে ছিল না অভিযোগের সুর, ছিল না প্রতিবাদ। উবাইদুল্লাহ তাকে ভৎর্সনা করছিলেন না। তার আগুনঝরা বক্তব্য থেকে শব্দ আসছিল, আমীরে স্পেন কিছু করবেন না করার যা তা আমিই করব।
আবদুর রহমান তাকে খামোশ করানোর বহু কোশেশ করেছিলেন, কিন্তু এতে ভেতরে ভেতরে তার জ্বলে ছাই হবার উপক্রম। তাঁর রাজমহল ও ব্যক্তিত্ব সামান্য এক সালারের উত্তেজক বক্তব্যের মাঝে লীন হয়ে যাচ্ছে। উবাইদুল্লাহ তাকে বনি উমাইয়ার কাহিনী শোনাচ্ছিলেন। আবদুর রহমান বনি উমাইয়ার নয়ন মনি। এটা কোনো কেচ্ছা নয় বরং এটাই ওইযুগের খেলাফত ও স্পেনের বাস্তব ইতিহাসের প্রতিফলন। ইতিহাস আমাদের কাছে এভাবেই পৌঁছেছে। এই ইতিহাসের তেমন একটা গুরুত্ব না দেয়ার কারণে আমাদের পতন ও অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়েছে।