আমীর সাহেব! আমার যদ্র বিশ্বাস দেশের প্রকৃত খবরাখবর আপনার থেকে সযতে গোপন করা হয়েছে।
আমি একজন মানুষ বৈ তো নই। আবদুর রহমান সাদামাটা গলায় জবাব দেন। এই জবাবের মধ্যে শাহী দাপটের লেশমাত্র নেই। আমি তো আর গোটাদেশে সফর করে খবর নিতে পারি না। আমার কানে যে খবর দেয়া হয় একেই সত্য ও বিশ্বস্ত বলে মনে করি।
আবদুর রহমানের টেবিলে একটুকরা কাগজ পড়ে ছিল, এতে দীর্ঘ কবিতা লেখা। কথার ফাঁকে উবাইদুল্লাহ তা পড়ে ফেলেন। কোনো কবি এটা স্পেন-আমীরের নামে লেখেন। কাগজটি হাতে তুলে নেন উবাইদুল্লাহ বলেন, আলীজাহ! স্পেন যদি আপনার জায়গীর হত আর আমি যদি আপনার কেনা গোলাম হতাম তাহলে সর্বাগ্রে আপনার সম্মুখে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করতাম। এমন দিস্তার পর দিস্তা কবিতা লেখতাম আপনার স্তুতি বন্দনায়। আপনার কানে যা দেয়া হয় অবলীলায় তাকে সত্য বলে মেনে নেন কেন? আলীজাহ! বলুন! কেন এমনটা হচ্ছে?
উবাইদুল্লাহ! তোমাদের হয়েছেটা কি শুনি! আবদুল করিম ও আবদুর রউফও কেমন যেন আমার প্রতি অসন্তুষ্ট। আমি বুঝতে পারি ওরা কি বলতে চায়। ওদের জবা সম্পর্কে আমি সবিশেষ অবগত, কিন্তু তোমরা কেন দরবারের শ্রদ্ধা-সম্মান ও আদব ভুলতে বসেছ সকলেই।
আর এ সেই বিষ যা স্পেনের শিরা-উপশিরায় প্রবিষ্ট হচ্ছে। চাটুকারদের প্রতি আপনি ঝুঁকে পড়েছেন। কলমবাজ, ফটকবাজ কবি-সাহিত্যিকের কলম আপনার দিল দেমাগে বাসা বেঁধেছে। আপনার কান কেবল চাটুকারদের স্তুতিগান শুনতে অভ্যস্ত। আরেক বিষ হচ্ছে, যাকে আপনি দরবারী আদব বলছেন, ইসলামে দরবার কেবল খোদার হয় যেখানে আমরা সিজদা করি। আলীজাহ! আপনি আপনাকে খোদা বানাবেন না।
কি বলছ উবাইদুল্লাহ। আবদুর রহমান গর্জে উঠলেন, তুমি আমাকে ফেরাউন ঠাওরাচ্ছ?
***
উবাইদুল্লাহ কিছু বলতে যাবেন এমন সময় যিরাব সেখানে প্রবেশ করল। সালার তাকে দেখে কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান। সে দুহাত প্রসারিত করে উবাইদুল্লাহকে বগলদাবা করতে আসে।
আমার ভাই! বিজেতা সিপাই সালার উবাইদুল্লাহ। কোলাকুলিতে উদ্যত যিরাব অগ্রসর হয়ে বলল। সেনাপতি বসে বসেই কেবল মোসাফাহা করলেন। যিরাব খুশীতে গদগদচিত্তে বলল, আলীজাহ! আমরা সেনাপতি মহোদয়ের জন্য বিজয়োসব করব। আমার পুরোদল এমন নাচ নাচবে, আসমানের অযুত সেতারা যা দেখে বিমোহিত হয়ে যাবে। এমন গীত শোনাবে যা আপনারা শোনেন নি কোনদিনও।
হা হা যিরাব! আবদুর রহমান ভাঙ্গাকণ্ঠে বললেন, ও আমার বাঘ! স্পেনের বাঘ এখন শ্রান্ত-ক্লান্ত।
কেমন উৎসব পালন করবে যিরাব? সালার বললেন, সেই শহীদানের উৎসব পালন করবে, দরবারীরা যাদের সম্পর্কে এতটুকু জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেনি যে, তারা কি জন্য জান কোরবান করেছে?
ইতোমধ্যে সুলতানা কামরায় প্রবেশ করল। সেও যিরাবের ন্যায় আনন্দ জাহির করল। করল উৎসবের অভিব্যক্তি। বসে গেল আবদুর রহমানের পাশে। উবাইদুল্লাহ লক্ষ্য করছেন, তার কথায় আবদুর রহমানের চেহারায় যে উদাসীনতার ছাপ পড়েছিল সুলতানার স্পর্শে তা মুহূর্তে দূরীভূত হল। উবাইদুল্লাহর দেহে আগুনের উত্তাপ কিন্তু তিনি দাঁত কামড়ে নিজকে সংযত করেন।
আলীজাহ! তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, রণাঙ্গনে মৃত্যুবরণকারীদের উৎসব পালনের পূর্বে আপনার সাথে নিরিবিলিতে কটি কথা বলতে চাই।
উবাইদুল্লাহ প্রত্যুৎপন্নমতি লোক। তিনি যিরাব ও সুলতানার চাল ভালভাবেই পরিজ্ঞাত। তাকে আগেভাগেই উজির ও নায়েব সালার বলে দিয়েছিল, এরা আবদুর রহমানকে একা থাকতে দেয় না। কোনো সালার কিংবা সরকারী কর্মকর্তা যখন মহলে আসেন তখনই তারা তার পাশে জেঁকের মত লেগে থাকে এবং আমীরের কানভারী করে থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই চাটুকাররা আমীরের কাঁধে এমনভাবে চেপে বসেছিল যার থেকে তার মুক্তি ছিল না। না ছিল ওদের ধর্মীয় কিংবা জাতীয় স্বার্থ। আবদুর রহমানসহ তার পূর্বেকার আমীরগণ দরবারে চাটুকার নিয়োগ করে আসছেন বরাবরই। ওরা বাইরের সঠিক রিপোর্ট পেশ করত না কখনই। চাটুকারিতাই ওদের ধর্ম। এরা সকলেই মুসলমান থাকা সত্ত্বেও নেপথ্যে ছিল খ্রীস্টশক্তির ক্রীড়নক।
উবাইদুল্লাহ নিরিবিলিতে কথা বলার আগ্রহ ব্যক্ত করতেই আবদুর রহমানের মুখটা মেঘলা দিনের মত কালো হয়ে ওঠে। এতে তাদের কথাবার্তায় কিছুটা তেতো স্বাদও এসে যায়।
বলুন আমি না হয় চলে যাই। সেনাপতি বলেন, তবে বলে রাখছি, আমি আপনার দরবার থেকে চলে যাব ঠিকই, তবে স্পেন থেকে নয়। এই অনুভূতি নিয়ে যাব না যে, স্পেন আপনার বাপ-দাদার সম্পত্তি। যতক্ষণ আমার ও আমার অধীন বাহিনীর দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ কাউকে এই চিন্তা করতে দেব না যে, স্পেন কারো কেনা জায়গীর।
আমি তোমার কথা শুনে চলছি। যিরাব ও সুলতানার সম্মুখে কথা বলতে তোমার আপত্তি থাকার কথা নয়।
আমি ওদের মুখের ওপরই বলছি যে, মহলের এক সামান্য গায়ক আর এক সুন্দরী নারী যদি রাষ্ট্রীয় গোপন আলোচনায় শরীক থাকে তাহলে এ দেশে না স্থায়ী হবেন আপনি, আর না স্পেন। আপনি আমীর না হলে আপনার মুখ দর্শনও করতাম না। যদি এ লোকটা গায়ক আর ঐ মেয়েটার মুখশ্রী নিটোল সুন্দর না হত তাহলে হয়ত আপনি এদের মুখও দেখতেন না। ওদের জাদু কেবল ওটাই। একজনের কাছে সংগীত অপর জনের কাছে সৌন্দর্য। এই সম্পদই আপনার অবস্থার ভিত্তি। বললেন সেনাপতি।