আমি এমন আহামরি কি করলাম তোমার জন্য। আবদুর জব্বার বললেন, প্রতিদান দেয়ার স্থলে তুমি আমাকে উদ্বিগ্নই করে তুলছ, তুমি দিতে এসেছ আমার মুখে চুনকালি।
যুবতী তার ১ হাত নিজের মুখে পুরে নিল এবং চোখ ঘেঁয়াল, পরে নামিয়ে দিল ঠোঁট।
আবদুর জব্বারের চেহারায় যৌবনের ইতিহাস। তার যৌবনের সেই সোনালী দিন এখন কেবল ধূসর অতীত। যুবতীর আবীর ছোঁয়া তাকে পেছন অতীতে নিয়ে চলে। নিযুতি রাত আর ভুবন মোহিনীর এই সম্মোহনী শক্তি আবদুর জব্বারকে তার পরিণতির কথা ভুলিয়ে দেয়।
রাত আরো গম্ভীর হতে থাকে। নেককার গভর্নর আর কুলটা যুবতীর জীবনে আরেক দুনিয়ার দরজা উন্মুক্ত হচ্ছিল। জীবনে যা তার কাছে অভাবনীয় ছিল তা বাস্তবে ধরা দিল। বড় মনোমুগ্ধকার হয়ে দেখা দিল। যেখানে তার তিনদিন থাকার কথা, সেখানে তিনি দশদিন থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরতে হল। অবশ্য যুবতীদের সাথে নিতে ভড়কালেন। ওদেরকে ওখানেই থাকার ব্যবস্থা করলেন। ডাকাতগংকে বললেন, এদের শান্তি-নিরাপত্তায় খেয়াল রাখতে। আরো বললেন, তিনি আসতে থাকবেন। এরপর তিনি চলে গেলেন।
যুবতীদের যাবতীয় ব্যবস্থা করল ওরাই যারা ওদেরকে কাফেলা থেকে বন্দী করে নিয়ে এসেছিল। মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বারের প্রস্থানের পর ডাকাতরা যুবতীদের কাছে এলো।
মনে হচ্ছে তোমাদের মিশন সফল হয়েছে। ডাকাত সর্দার বলল।
তোমরা বলতে লোকটা পাথুরে হৃদয়বিশিষ্ট। কিন্তু আমরা তাকে মোমের মত গলিয়ে দিয়েছি। যুবতী বলল।
গোনাহর একটি দরজা খুললে অন্যান্য দরজাও খুলে যেতে লাগল আবদুল জব্বারের জীবনে একে একে। জীবনের পিছল পথে গোনাহ অতি অবশ্যই ওঁত পেতে থাকে কিন্তু একে সামাল দেয় সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। অবশ্য ওঁত পাতা এই দুশমন মানব প্রতিরোধের পাহাড়কে দুমড়ে মুচড়ে থেতলে দেয়। যে আবদুল জব্বার বৈধ পন্থায় রাজস্ব আদায়কে ঈমানী দায়িত্ব বলে অংগীকারবদ্ধ ছিলেন, সেই আবদুল জব্বারই নীতিজ্ঞানহীন খ্রীষ্টানদের মায়াজালে আটকে পড়লেন। তার সে এমন এক মায়াজাল, এমন এক সম্মোহনী শক্তি যা যে কোন গোনাহর জন্ম দিয়ে চলে একের পর এক। তিনি অধিকাংশ সময়ই দেশ শাসন ছেড়ে সফরে বের হতেন। আসতেন সেই গ্রামে যেখানে ঐ দুযুবতীর অবস্থান।এরা সেই যুবতী যারা পয়লা মোলাকাতে কেঁদেছিল এক্ষণে হাসিখুশিতে কালাতিপাত করতে লাগল। ওরা কুলটা হতে শাহযাদীতে রূপান্তরিত হল। পুরানো দিনের পোড়াবাড়ী প্রাসাদোপম অট্টালিকায় রূপ নিল। সেই মহলে শরাব আমদানী হল। অল্পদিনে নতকীরও অন্তর্ভুক্তি হল। এই জলসা সাজাতে চাই কাড়ি কাঁড়ি অর্থ। আবদুল জব্বার ট্যাক্সের আমানতে খেয়ানত করতে শুরু করলেন। ডাকাতের সূচী লম্বা হতে লাগল। আবদুল জব্বার রীতিমত হেরেম বানালেন। বনে গেলেন মুকুটহীন সম্রাট।
***
অল্পদিনের ব্যবধানেই তিনি আঁচ করতে পারলেন তার আশেপাশে যারা চাটু কারের ভূমিকার ছিল তাদের সকলেই খ্রীস্টান। তমধ্যে মুসলমানও ছিল। কিন্তু সকলেই নও মুসলিম। যারা বাহ্যত নব দীক্ষিত মুসলিম হলেও তলে তলে কুশ পূজারী। ওরা নেপথ্যে পেয়ে যেতে লাগল মুসলিম শেকড় কাটার ষড়যন্ত্র বার্তা। আবদুর জব্বারের উপদেষ্টারা যেতেন-এরা তারই নির্বাচিত। তারা তাকে রঙ্গ-রসের আসরে গলা অবধি ডুবিয়ে রাখল। এরা শুধু তার ডান হাত নয় তার রহস্যের সংরক্ষকও।
একবার তার এই করুণ দশা দেখতে পেল ন্যায়নিষ্ঠ এক মুসলিম সেনা। তিনি তাদেরকে এনাম দেয়ার টোপে তথ্য প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। এর ভেতরে-বাইরের দশা দেখে রীতিমত কেঁপে উঠলেন তিনি। দেখলেন দিগম্বর নর্তকীরা কোমর দুলিয়ে নাচছে, শরাবের বন্যা বইছে। পরদিন আবদুল জব্বার অধিবেশন ডাকেন। ট্যাক্স অনাদায়ী লোকদের হাজির করা হয়। তারা টাক্স আদায়ের অপারগতার কথা শোনায়, আব্দুল জব্বার জনগণের পক্ষেই সব সময় ফায়সালা করতেন। কাজেই এই অধিবেশনের ফায়সালা ওদের পক্ষেই গেল।
আবদুল জব্বার মাদ্রিদ চলে গেলেন। তার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান সালারকে জিজ্ঞেস করলেন, আবদুল জব্বার বাইরে কোথায় যান? খাজাঞ্চিখানা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। ট্যাক্স ফাঁকিদাতাদের গ্রেফতার না করে তাদের ফোর্সে শামিল করেছেন।
আবদুল জব্বার আর মাদ্রিদ ফিরলেন না। মাস্তান গুণ্ডাদের নিয়ে তিনি ওখানেই এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুললেন। ডাকাত দলের প্রধানকে ডেকে গোটা এলাকায় এ মর্মে ঘোষণা করতে বললেন যে, আজ থেকে আবদুল জব্বার এখানেই থাকবেন-মাদ্রিদ যাবেন না। ট্যাক্সের অফিস এখানেই খোলা হচ্ছে। কাজেই ট্যাক্স এখন থেকে এখানে আদায় করতে হবে। এলোগেইছ এবার পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তার মিশন সাকসেসফুল। তখন আবদুর জব্বার তার টোপ গিলে ফেলেছে। কাজেই তাঁর সাথে কথা বলা যায়। বলা দরকার। এলোগেইছ এসে বলল,
আপনাকে মনে রাখতে হবে, জীবন চলার পথে একাকী মুসাফির নন আপনি। এক্ষণে আপনার কোন প্রভাব কিংবা মূল্যায়ন নেই। যে কোন সময় আপনাকে হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু আপনাকে আমি মাদ্রিদের স্বাধীন রাজা বানাব। মাদ্রিদ হবে খণ্ডিত স্পেনের স্বাধীন রাজ্য। খ্রীস্টান ও নবদীক্ষিত মুসলমানরাই আপনাকে সাহায্য করবে। ওরাই আপনার বাহিনী। আপনার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের অপচেষ্টা চালিয়ে আমাদের ধোকা দেয়ার চেষ্টা করলে পরিণাম এতই ভয়াবহ হবে যে, এর কল্পনাও করতে পারবেন না আপনি।