মাদ্রিদে আবদুল জব্বার নামী শাসককে এতদিন নেককার মুমিন বলে জেনেছি। বর্তমান শুনেছি সে নাকি গদিলাভের স্বপ্ন দেখছে। আমি তাকে হাতের মুঠোয় আনতে চাই। আমাদের কিছুলোক তার পিছু নিয়েছে। তাকে আমার চাই। শুধুই আমার। শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে এলোগেইছের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।
***
মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বার স্পেন। আমীর দ্বিতীয় আবদুর রহমান ইবনে হাকামের যুগে স্পেনের বিখ্যাত রাজনীতিজ্ঞে পরিণত হয়েছিলেন। তবে সুখ্যাতি নয় তার নামে ছড়িয়েছিল কুখ্যাতি। আবদুর রহমানের বাবা আল-হাকামের যুগে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, জনগণের ওপর থেকে ট্যাক্স উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। এদিকে আবদুর রহমানের যুগে কোষাগার প্রতিনিয়ত তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত হতে চলেছিল। কথিত আছে, সীমান্তে যেহেতু প্রায়শই বিদ্রোহ হত সেহেতু সেনা প্রেরণ করতে হত। বারবার ব্যাটালিয়ন প্রেরণের কারণে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বেড়ে যেত। এর চেয়ে বেশী ব্যয় হত মহল সামলাতে। যিরাব ও সুলতানা স্পেনরাজের জন্য খাই খাই হাতিতে পরিণত হয়েছিল। সর্বোপরি চাটুকারদেরও আবদুর রহমান সেলামি দেয়া শুরু করেন। যিরাব ও সুলতানা যাকে যখন যেমন চাইত বখশিস দিত।
এসব ট্যাক্সের অতিরিক্ত বোঝাটা চাপানো হত মাদ্রিদের জনগণের ওপর। মাদ্রিদ ওইযুগে এ যুগের প্রদেশের মত ছিল। ট্যাক্স, কর ও বখরা উসুলের জন্য কর্মী নিযুক্ত ছিল। মাদ্রিদের গভর্নর ছিলেন আবদুর জব্বার, তার প্রায়শই গ্রাম-গঞ্জে সফর করতে হত। তিনি ছিলেন দ্বীনদার গভর্নর এবং কঠোর প্রশাসক। এজন্য লোকেরা তাকে সমীহ করে চলত। তার প্রভাবে প্রভাবিত থাকত।
সরকারী বডিগার্ড ছাড়াও তার আশেপাশে ঠাই দিয়েছিলেন গ্রাম্য লড়াকু মাস্তান ও গুণ্ডাদের। এরা ট্যাক্স আদায় করে আবদুল জব্বারের খুব মদদ করতেন। এরা বখশিসের যোগ্য ছিল, কিন্তু উসুলকৃত ট্যাক্স থেকে সামান্যও দিতেন না তিনি। এই চক্র একটি পন্থা বের করে। সেই পন্থার নাম ডাকাতি। তারা অযথা হয়রানি করে কাফেলার গতিরোধ করে চাঁদাবাজি করত।
এদের ছাড়া আবদুল জব্বার ছিলেন অসহায়। তিনি এই রাহাজানির পথ রুদ্ধ করেন। তিনি বলেন, তোমরা পাইকারী হারে রাহাজানি করো না-একটু আধটু করলে তাতে আপত্তি নেই। মাস্তান গং এই প্রস্তাব লুফে নিল। ওরা দুএকদিন পরপর কাফেলার গতিরোধ করে। একবার তারা একটি কাফেলার গতিরোধ করে একটি তলোয়ার আবদুল জব্বারকে হাদিয়া দিল। পর্যায়ক্রমে এভাবে তারা দুএকটা উপহার গভর্নরকে দিয়ে চলত।
***
লুটের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকল, আবদুর জব্বার ডাকাতদের হাদিয়া কবুল করে যেতে থাকলেন। কিন্তু উসুলকৃত ট্যাক্সের কানাকড়িও তাদের দিতেন না। একবার তিনি শহর থেকে দূরে কোন এলাকায় ট্যাক্স আদায় করতে গেলেন। তাকে দুচারদিন ওখানে থাকার দরকার ছিল। রাতের বেলা ডাকাতদল তার কাছে এলো। সাথে তাদের সুন্দরী দুযুবতী। ডাকাতরা বলল, এ সামান্য তোহফা। এরা কাফেলা থেকে এদের অপহরণ করেছিল।
মুহাম্মদ ইবনে জব্বার এই তোহফা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন।
আপনি এদের একজনকে না হয় গ্রহণ করুন। ডাকাতদের একজনে বলল, দুজন রাখলে আপত্তি নেই।
ডাকাতির যে মাল আমি এতদিন গ্রহণ করে এসেছি তাও এক ধরনের গোনাহ। কিন্তু এই যুবতীদের গ্রহণ করে কবিরা গোনাহ করতে পারব না। নিয়ে যাও ওদের। আবদুর জব্বারের কণ্ঠে তিরস্কার।
এক যুবতী তার পথে আছড়ে পড়ল, অপরজন ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
আমাদেরকে আপনার কাছে রাখুন। আছড়ে পড়া যুবতী বলল, আমাদেরকে ওই হিংস পশুদের হাতে সোপর্দ করবেন না।
যুবতীরা দেখল লোকটা খুবই সৎ। খুব সম্ভব তিনি তাদেরকে বাড়ী ফেরৎ পাঠাবেন, প্রথমজন বলল, আপনি আমাদের ফেরৎ না পাঠিয়ে আপনার স্ত্রীত্বে বরণ করুন।
উভয়ে এমনভাবে কাকুতি মিনতি করল যাতে আবদুল জব্বারের মন গলে গেল। তিনি বললেন, আমি এই তোহফা কবুল করলাম। আমি ওদের বাবা-মার কাছে পৌঁছালে তোমাদের কোন আপত্তি থাকবে না তো!
শর্ত হচ্ছে, আমাদের গ্রেফতার করবেন না। ডাকাত সর্দার বলল।
তোমাদের কেউ গ্রেফতার করবে না। তোমরা যাও। এদেরকে আমার কাছে থাকতে দাও। গভর্নর বললেন।
ডাকাতরা চলে গেল। আবদুর জব্বার যুবতীদের বললেন, তোমরা এখন নিরাপদ। রাতে তোমাদের আলাদা কামরায় থাকতে দেয়া হবে। আমার কাজ শেষ হলে তোমাদের বাড়ী পৌঁছে দেব।
তিনি ওদের ওপাশের কামরায় পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, চাইলে দরজায় ছিটকিনি ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে পার। এরা উভয়ে এমন খুবসুরত ছিল যে, নেহাৎ নেককার হওয়া সত্ত্বেও কেমন যেন তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। জীবনে এমন নারী এই প্রথম দেখছেন তিনি।
১.৫ গভীর রাত
গাঢ় নিদ্রায় বিভোর আবদুর জব্বার। কামরার কোণে টিমটিম করে জ্বলছে কুপি। আচমকা তার দৃষ্টি খুলে গেল। কে যেন তাকে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগাচ্ছে। কে তাকে এভাবে জাগাতে পারে? ধড়ফড়িয়ে উঠলেন তিনি। সহসাই তলোয়ার উঁচিয়ে ধরেন। আবছা আলোয় খাটের কোণে জনৈক তরুণীকে দণ্ডায়মান দেখেন তিনি।
তুমি! তুমি এখানে?
আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। আমি এর অযোগ্য হলে বলুন কি করে আপনার এই অনুদান শোধ কর। বলে যুবতী খাটের কোণে বসে গেল।