স্পেনরাজের হরমের দুজন খ্রীস্টান নারী বলেছে, আবদুর রহমানের দিমাগ পরিষ্কার করা হয়েছে। তিনি তাই এ ঘটনাকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছেন না, অপর ঈসায়ী বলল।
গীর্জায় এক্ষণে খ্রীস্টানরা আবারো জমায়েত হচ্ছে। তাদের প্রতিশোধস্পৃহা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। প্রথম খ্রীস্টান বলল।
আমি মুসলমানদের মধ্যে এর বেশ প্রতিক্রিয়া দেখেছি। সিংহভাগ মুসলমানের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, হযরত ঈসা (আ)-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, আর এই আগুন তাদের বদ দোয়ার কারণে লেগেছে। দ্বিতীয়জন বলল।
এই আগুন আমরা নিভতে দেব না। বলল- এলোগেইছ এদের পুরোকথা শোনার পর, তোমরা কর্ডোভায় ফিরে যাও, আমি মাদ্রিদ যাচ্ছি।
এলোগেইছ যে পাদ্রীর আশ্রয়ে ছিল সে জিজ্ঞেস করল, মাদ্রিদ গিয়ে তুমি কি করবে- কর্ডোভায় কেন যাবে না? বিদ্রোহাগ্নি জ্বলছে-একে এগিয়ে নেয়া দরকার নয় কি?
আমার দৃষ্টি এ মুহূর্তে গোটা স্পেনকে নিয়ে দেখতে চায়। এলোগেই বলল, এ মুহূর্তে মাদ্রিদে একপশলা স্ফুলিঙ্গ জ্বালানো দরকার। এতদুদ্দেশে আমার জনৈক সহপাঠী ওখানে আগেই চলে গেছে। ওখানে এমন এক মুসলিম শাসক রয়েছে যাকে আমরা বিদ্রোহী ভরে তুলতে পারি। আমার প্ল্যান হচ্ছে, বিদ্রোহের দায়ভার নিজেদের কাঁধে না নিয়ে কোন মুসলমানে ওপর দায়ভার চাপানো।
তুমি এমন কোনো মুসলমানকে দলে পাওয়ার আশাবাদী, যে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধুম্র গিরি উদগীরণ করবে? পাদ্রী জিজ্ঞেস করল, দেখো, কোনো মুসলমান তোমার সহপাঠীর সাথে হাত মিলিয়ে না আবার তোমায় শ্রীঘরে পাঠায়। তোমার অনুপস্থিতিতে ওই বিদ্রোহাগ্নি তো সহসাই নিভে যাবে।
এলোগেইছকে খোদাতাআলা এমন কিছু গুণ দান করেছিলেন যা অন্যের বেলায় করেননি। সে কোরআন গবেষণার এতই গভীর পৌঁছেছিল যে, মুসলিম মনীষীরা যে গভীরে পৌঁছুতে পারেননি। কোরআন গবেষণার দরুন সে স্বধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নামকাওয়াস্তের খ্রীষ্টানে পর্যবসিত হলেও প্যাম্পোলনার প্রাচীন গির্জায় গভীর রাতে জনৈক পাদ্রীর লিখিত একখানা পুস্তক আবিষ্কার করল। ওই বইতে ইসলাম ও এর নবীর বিরুদ্ধে কুত্সায় ভরা। মনগড়া কথকতায় ঠাসা। ইসলামের প্রতি কোরআন গবেষণার দ্বারা যে প্রভাব তার মনে দাগ কেটেছিল ওই পাণ্ডুলিপি পড়ে তার খ্রীস্টত্ব পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তার ইসলাম মিত্ৰতা সে সময় বৈরিতায় পর্যবসিত হলো। মুহূর্তেই মুসলমানদের ঘোরর দুশমনে পরিণত হল।
সর্বাগ্রে তাই সে জনৈক ঈসায়ী আলেম সেন্ট জুলিয়াসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। পরে সে কেবল খ্রীস্টীয় আলেমই নয় বরং মানুষের দুর্বল পয়েন্টগুলো জেনে যথোপযুক্ত আঘাত করার বুৎপত্তি অর্জন করল। যিরাবের মত চৌকস লোককেও সে নাচের পুতুলে পরিণত করেছিল। কর্ডোভার ঈসা মসীহের তথাকথিত আত্মপ্রকাশ তারই তীক্ষ্ণমেধার ফসল। পরিস্থিতি যেমনই হোক একে অনুকূলে নিয়ে আসার যোগ্যতাটুকু ছিল তার পুরোপুরিই।
বিছানো কুটিল ফাঁদের রিপোর্টগুলো এবার সে নিতে শুরু করল একে একে। পাদ্রী তাকে বলেছিল, কোনো মুসলমানের ওপর আস্থা না আনতে। কেননা এ জাতি খুবই ধূর্ত। শেয়াল যাদের কাছে হার মানে।
নারী ও ধন-দৌলত এমন এক সম্মোহনী শক্তি যা স্বীয় ইবাদতগাহে পর্যন্ত আগুন লাগাতে পারে। এলোগেইছ বলল, আমি যতটা ইঞ্জিলের আলেম ততটা কোরআনেরও। ও দুধর্মগ্রন্থে খোদাতায়ালা ধনের মোহ থেকে দূরে থাকতে এবং কোনো নারীকে ভাল লাগলে তাকে বিয়ে করে নিতে বলেছেন। অবৈধভাবে কোনো নারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সাজা মৃত্যু। ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে কোরআন পাথরাঘাতে শেষ করতে বলেছে। ইঞ্জিলের বিধানও এমন………কিন্তু কেন? কেন এত কঠোর? কেননা একজন সুন্দরী নারী দেশ-জাতির এতটা ক্ষতিসাধন করতে পারে-যা। পারে না একটি দেশের সব সৈন্য মিলেও।
নারী এক ধরনের মদ। এক ধরনের নেশা। এক প্রকারের যাদু আছে যা বড় বড় যুদ্ধংদেহীকে পর্যন্ত কুপোকাত করেছে। দিগ্বিজয়ী বীরবিক্রমকে সে নাচের পুতুল বানিয়েছে। এর চেয়ে মারাত্মক নেশা হচ্ছে মনি মান্নিক্যের ও রাজ সিংহাসনের। কোনো মানুষকে গদীর লোভ দেখালে দেখবে সে তার ঔরসের মেয়েকে নিলাম করে দেবে। মিথ্যা কথা বলবে। নিজ খোদা ও ধর্মকে পর্যন্ত মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। একদিকে সে যেমন খানার মুখ খুলবে তেমনি খুলবে কয়েদখানার মুখও। কাউকে অন্ন-অস্ত্রে দুহাত ভরে দেবে আবার কাউকে শ্রীঘরে পাঠিয়ে রাজার্সন পোক্ত করবে।
এরপরও আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে, পাদ্রী বলল, অনেক ক্ষেত্রে পরিপক্ক কানুন ও দর্শন বিফল হয়ে থাকে।
আবদুর রহমানের মত চৌকস ও পাক্কা মুমিন যদি নারীর বাহুতে আটকে যেতে পারে তাহলে আমার মনে হয় দুনিয়াতে এমন কোনো মুসলমান নেই-নারীর মোহ থেকে যে বাঁচতে সক্ষম। যবান থেকে এক্ষণে আমার পরিকল্পনা ফাঁস করব না-এটা এক ধরনের গোনাহ। আমার মিশন খ্রীষ্টবাদ ও স্পেনকে মুসলিম মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। ধর্ম ও জাতির জন্য তাই মিথ্যা বলতেও রাজি আমি। এতে সওয়াবেরও আশা করি। আমি হুকুমত চাই না, চাই না আত্ম প্রসিদ্ধি। আমি নিজেকেই নিজে হাতে হত্যা করেছি। মুসলিম ঘরনা ও শাসকবর্গকে জিন্দা রাখার কোশেশ করছি। বাহ্যত তাদের মধ্যে একতা দেখাব, কিন্তু পরস্পরকে পরস্পরের দুশমন বানাব। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে এর বিকল্প নেই।