জনগণ কেন্দ্রীয় মুসলিম খলিফাঁকে চেনে না, চেনে কেবল স্পেনরাজকে। তথ্য উপদেষ্টা আবদুর রহমানকে বলল,
কোথাও কি বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে না? প্রশ্ন করেন তিনি।
বিদ্রোহ? কি ধরনের বিদ্রোহ? মুসলিম খ্রীস্টান সকলেই হুজুরের নামে সেজদা করে। পাগল মাত্রই বিদ্রোহের কথা ভাবতে পারে। বলল তথ্য উপদেষ্টা।
প্রতি সন্ধ্যায়, তাকে এমন খবর দেয়া হত যাতে খোদার পরেই তাকে আসন দানের প্রয়াস থাকত। তিনি প্রজাদেরকে চাটুকার আমলাদের মত মনে করতেন এবং ওদের কান দ্বারা বাইরের খবর শোনতেন। এরাই স্পেন গভর্নরকে স্পেন সম্রাটে, পরিণত করেছিল।
গোটা স্পেনে যখন বিদ্রোহের ধূম্রগিরি উদগীরণ, হচ্ছিল, যখন ভেল্কিবাজির আগুন খ্রীষ্ট সমাজে মুসলিম বিদ্বেষী চেতনা ছড়াচ্ছিল; ঠিক তখন চাটুকাররা প্রজারা রাজাকে সেজদা করে-এমন খবর পরিবেশন করত। স্পেনের সেই আমীরের সামনে যিনি আলেম, বিজ্ঞ, রাজনীতিজ্ঞ, তর্কবাগিশ, ধীমান এবং যার তলোয়ারের সামনে ফ্রান্স সম্রাট লুই এবং আল-ফাপ্পর মত যুদ্ধংদেহী যার সামনে মাথা নোয়াত। কিন্তু তিনি আঁচ করতে পারলেন না চাটুকাররা কিছু বলছে আর পর্দার আড়ালে অন্য কিছু করছে। তাদের দ্বারা যা কিছু বলা হচ্ছে কিং করানো হচ্ছে-তাই আগামী দিনের ইতিহাস, ইতিহাস ইসলামের।
ইতিহাস যেমন শিক্ষাপ্রদ তেমনি আলোবর্তিকাও। অনাগত ভবিষ্যৎ যেমন এর আলোকে পথভ্রষ্ট হতে পারে ঠিক তেমনি এর দ্বারা মঞ্জিলে-মকসুদেও পৌঁছতে পারে। পথ হারিয়ে ফেলা কিংবা পথপ্রাপ্তির মানদণ্ড হচ্ছে, পূর্বসূরিদের মিথ্যা বলা কিংবা সত্য বলা। যে জাতির ইতিহাসে চাটুকার ও গাদ্দারদের প্রবল দখল তাদের ইতিহাসের পৃষ্ঠা অবশ্যই মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। মানুষ মানুষকে আত্মপূজারী বানাতে পারে। বানাতে পারে রাজাও, কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা বড় কঠিন ও ভয়াল।
হিন্দুস্তানে মোঘল ও স্পেনে বনি উমাইয়ারা যে ইতিহাস রচনা করেছে তা চাটুকারদেরই হাতে লেখা, যার ওপর আমরা গর্ব করে থাকি। প্রাচ্যের তাজমহল, শাহী মসজিদ আর পাশ্চাত্যের আলহামরা, কর্ডোভা মসজিদ দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই, কিন্তু আমাদের কজনা এই চিন্তা করেন যে, এই স্থাপত্য শিল্পীদের অবক্ষয় এল কেন? কেন ইসলামী সাম্রাজ্য শত খণ্ডে খণ্ডিত হল?
এই কার্যক্রম চাটুকার ও গাদ্দারদের যারা প্রশাসনের বিবেচনার ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। এরা তারাই যারা এই প্রশাসনের মৃত্যুর পর তাদের কবরের ওপর প্রমোদ ভবন নির্মাণ করেছিল। স্পেন ইতিহাসের এক একটি পৃষ্ঠা ও এক একটা শব্দের ওপর চিন্তা করলে আমাদের স্বতঃই উপলব্ধি হবে যে, শতাব্দীকাল ধরে আমরা সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছি। চাটুকার উপদেষ্টারা আমাদের প্রশাসনকে দেশী-বিদেশী পুরস্কার ও সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে তাদের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডকে ধামাচাপা দিচ্ছে। রাজা-প্রজার সম্পর্ক আজ সাপে-নেউলে পর্যায়ের। আজকের শাসকবর্গ মনে করছে, তারা যাই কিছু করুক না কেন প্রজারা তাদের সম্মুখে করজোড় প্রণাম রত আছে, থাকবে।
***
যে সন্ধ্যায় আবদুর রহমানকে ওই খবর শোনানো হয় সেই খবরের কোথাও খ্রীস্ট প্রজ্বলন ও তাদের বিরূপ জাগরণের নামোল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। এমন কি খোদ আবদুর রহমান প্রশ্ন করেন যে, এ ব্যাপারে কি কোন খবর নেই?
এমন কিছু হয়নি যা বলার মত। কেউ তাকে উত্তর দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওই দিন প্রত্যূষে বলা উজির ও সেনাপতির কথা মনে পড়ে যায়। তারা বলেছিলেন, আপনি আরাম করুন আমরা জিন্দা আছি। ইসলামকে আমরা জিন্দা রাখবই। ইসলামেরাও সম্ভ্রম রক্ষা তাদের দ্বারাই হবে যাদের লাশ আপনার দরজায় পড়ে আছে।
যদি বলার মত গুরুত্বপূর্ণ কথা না-ই হবে তাহলে গির্জায় ঘন্টা বাজলো কেন? প্রশ্ন আবদুর রহমানের, তোমরা ওই শহীদানের নামোল্লেখ করোনি আজ যাদের দাফন করা হয়েছে, জনগণ তাদের জানাযায় শরীক হয়েছে। তাদের মাঝে নানান কথার কানাঘুষা, নানান অভিমত, আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে নিশ্চয়ই।
স্পেনরাজের এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় কৈ? এ বিষয় নিয়ে তারাই ভেবে দেখবে যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট। আপনি নিশ্চিত থাকুন। যিরাব বললেন।
যে রাতে তথ্য সন্ত্রাস দ্বারা আবদুর রহমানকে অবোধ শিশুর মত ঘুম পাড়ানো হচ্ছিল সে রাতে কর্ডোভা থেকে ৫০/৬০ মাইল দূরে জনৈক দুঘোড়া চালক এলোগেইছকে বোঝাচ্ছিল যে, পুরাতন গির্জায় যে ঈসা-নাটক শুরু হয়েছিল, দুর্ভাগ্যজনক হলেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তা। অবশ্য এর দ্বারা উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে পুরোপুরি। রাতের বেলায় ঘটা করে এ কাহিনী তাকে সবিস্তার শোনানো হয়। বলা হয়, গীর্জায় লাগানো ভেল্কিবাজির কথা। এরা সেই লোক যাদেরকে গীর্জা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং পরে আবদুর রহমান যাদেরকে রেহাই করে দিয়েছিলেন।
তোমাদের মুক্তি দেয়ার অর্থ এই যে, আবদুর রহমানের কাছে ব্যাপারটায় তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। আমলারা এ ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া জাহির করেছে? প্রশ্ন করে এলোগেইছ, আপনি যথার্থই অনুমান করেছেন। স্পেনরাজের সম্মুখ হাজির করার পূর্বে যিরাব আমাদেরকে বাইরে এনে বলে দিয়েছিল, কি বলতে হবে আবদুর রহমানের সামনে। যিরাব ও সুলতানা স্পেনরাজের দিমাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমরা মজলুমের অভিনয়ে বলেছিলাম, আপনার আমলারা সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে আমাদের গীর্জায় আগুন দিয়েছিল। বলল জনৈক ঈসায়ী।