ইয়াহইয়া এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন এমতাবস্থায় এক কয়েদী বলে উঠল, উজির ও সালার তো কোন ফেরেশতার নাম নয়। ধর্মীয় উন্মাদনায় তারা আমাদের ওপর জুলুম করেছে। কিন্তু তারা ধারণা করেনি যে, এতে খ্রিস্টান সমাজ তাদের বিরুদ্ধে গেছে। আমরা আপনার বিশ্বস্ত প্রজা। ফ্রান্স সম্রাট লুই আর আল-ফাও খ্রিস্টান-এতদসত্ত্বেও আমরা তাদের বিরোধী, কেননা তারা আপনার দুশমন। দুশমন স্পেনের।
ওদের দুজনকে বাইরে নিয়ে যাও। আবদূল রহমান বললেন, আমাকে ভাববার একটু সময় দাও।
কয়েদীদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। যিরাবের ঠোঁটে খেলে গেল আঠাল হাসি। ইয়াহইয়া গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। আবদুর রহমানের গালে হাত। তার ও ইয়াহইয়ার জানা নেই যে, স্পেনরাজ গোসলখানায় গেলে যিরাব বেরিয়ে গিয়েছিল। সাথে নিয়ে ছিল দুকয়েদীকে। যিরাব যেহেতু দরবারী লোক, সেহেতু সেপাই বা কয়েদীদ্বয়কে তার হাতে তুলে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি।
আমি উজির ও সালারের বিরুদ্ধে যাব? না না, তা হয় না। আবদুর রহমান ইয়াহইয়াকে প্রশ্ন করে নিজেই স্বগতোক্তি করেন।
হ্যাঁ। তাই। উজিরের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবে না। বললেন ইয়াহইয়া। যিরাব তার সুরে সুর মিলিয়ে বলল, হ্যাঁ! উজির ও সালারের বিরুদ্ধে যাবার ঝুঁকি নিতে যাবেন না। আবদুল করীম যেমন উজির তেমনি তিনি সালারও। তিনি মারাত্মক একটি ভুল করেছেন, তাই বলে পরিস্থিতি এখনও হাতের বাইরে যায়নি। আমি খ্রিস্টানদের উত্তেজনা প্রশমনে যারপরনাই চেষ্টা করব। আপনি এদের মুক্তি দিন।
আপনি চাইলে তাই করুন। ইয়াহ্ইয়া বললেন, তবে এটা ভুলবেন না যে, বিদ্রোহ ফুঁসে উঠছে। আমি যদুর নিরপেক্ষ সূত্রে জেনেছি এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে, রহস্যপূর্ণ রশ্মির মাধ্যমে পুরানো ওই গির্জায় স্পেনের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের উঙ্কে দেয়া হয়েছে। তবে কে এর হোতা তা জানা যায় নি। আমার পরামর্শ হচ্ছে, ওদের দুজনকে রেহাই দিয়ে খ্রিস্টানদের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখা। গির্জায় আগুন জ্বেলে আপনি বিদ্রোহ নির্বাপিত করতে পারেন না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন।
কিছুক্ষণ এভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা হোল। ইয়াহইয়া খ্রিস্টানদের পক্ষাবলম্বন না করলেও তাদের মাঝে তার স্বার্থ নিহিত ছিল, তাই কথা কিছুটা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে তাদের পক্ষেই নিলেন। যিরাব ওপরে ওপরে আবদুর রহমানের লোক হলেও প্রকৃতপক্ষে সে খ্রিস্টানদের-ই মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন। এরা দুজন প্রভাব বিস্তার করে দুকয়েদীকে আবদুর রহমানের মুখ দিয়ে মুক্ত করার ঘোষণা বের করাল।
কর্ডোভার গির্জায় এই সময় অনবরত ঘন্টাধ্বনি বেজে উঠল। কখনও জোরে, আবার কখনও আস্তে। এটা গির্জার ঘন্টাধ্বনির সময় নয়। মনে হচ্ছে তাদের ওপর কোন মুসিবত এসেছে।
আবদুর রহমান পেরেশান হয়ে বললেন, ওদের কি হলো? কোন মুসিবত ধরল ওদের?
যিরাব বললেন, প্রাচীন গির্জায় আগুন কি কম মুসিবত? এটা শোকধ্বনি। ওদের শোক-বিলাপ কি করে রুখবো রাজন! আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওদের সান্তনা দেব। ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে ওখানেই শেষ করব।
***
প্রাচীন এই গির্জা ছিল পাহাড়ের ওপর। এর ওপর প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা কর্ডোভার মানুষেরা দেখেছিল। কর্ডোভার গির্জায় গির্জায় তথাকথিত ঈসা মসিহের সেই কল্পিত বাণী চর্চা হতে লাগল যে, তোমরা স্বধর্মে ফিরে এসো।
কর্ডোভার পোপ বিশপরা জনগণকে বলতে লাগল, তোমাদের সেই গির্জায় আজ মুসলমানরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে যেখানে তোমাদের ইশ্বর-পুত্রের আগমন ঘটেছিল। এই গির্জাই তার নিকট প্রিয়পাত্র ছিল। তিনি বলতেন, তোমরা দুশমনদের হাতে পুরাভূত হবে। কোন কোন গির্জায় এ আওয়াজও শ্রুত হলো যে, ঈসা মসিহ নিজেই ওই গির্জায় আগুন লাগিয়ে চলে গেছেন যেখানে তিনি আঁধার রাতে আসতেন।
গির্জার ঘন্টা বেজেই যাচ্ছিল যেন এটা আর বন্ধ হবে না, আবদুর রহমানের প্রাসাদে এর ঢন ঢন্ আওয়াজ গুঞ্জরিত হয়। তিনি সিংহাসনে এলে ওই আওয়াজ আরো জোরালো হয়। তিনি গর্জে উঠে বলেন, ওদেরকে বন্ধ করতে বল। আমিতো সিদ্ধান্ত ওদের পক্ষে দিয়েছি।
স্পেনরাজের হুকুম তামিল করতে দুজন গির্জার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাইরে শোনা যায় এদের বিলীয়মান ঘোড়ার খুরধ্বনি। খানিকবাদে ঘন্টাধ্বনি কমে যায়।
গীর্জার ঘন্টা বন্ধ হয়ে গেছে আমীর সাহেব। আবদুর রহমানকে জানাল কেউ।
হা হা! আমার কান আছে। বললেন তিনি।
কিন্তু আপনি ওই তুফানকে কি করে প্রতিহত করবেন, গির্জাকে কেন্দ্র করে যা ফুঁসে উঠছে? উজির আবদুল করিম বললেন, যিনি পদমর্যাদানুযায়ী তার পাশে। বসেছিলেন, মানুষের মধ্যে ধিকি ধিকি করে জ্বলা আগুন নেভানো কি প্রক্রিয়া আছে আপনার কাছে? আমীরে স্পেন। আমি এইমাত্র শহীদদের দাফন করে এসেছি।
শহীদ! শহীদ!! আবদুর রহমান আনমনে উচ্চারণ করেন। আবদুল করীম অন্য কোন প্রশ্ন থাকলে বল, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে একটু ভাবতে দাও। বলে তিনি দরবারের সকলকে অবাক করে দিয়ে অন্দরে চলে যান।
সন্ধ্যার দিকে আবদুর রহমানকে রোজকারমত সারাদিনের খবরাখবর শোনানো হচ্ছিল। তার তথ্য উপদেষ্টা ছিলো দুজন। সরাসরি তারা আবদুর রহমানের সাথে দেখা, করতে পারত না। জনৈক দরবারী আমলা এদের থেকে তথ্য নিত এবং কেবল সে সব খবরই আবদুর রহমানের কানে দিত যা শুনতে তিনি পছন্দ করতেন। যিরাব দরবারে ঠাই পাবার পর থেকে দেশের সুখকর খবর- গুলোই (স) তার গোচরে আনতেন আর খারাপ খবরগুলো সযতে এড়িয়ে যেতেন।