আফসোস! আমার কারণে……………যিরাব বলতে লাগলো।
হাজেব তার কথার মাঝে বললেন, তোমার কথার কোন মূল্যায়ন নেই আমাদের কাছে মিঃ যিরাব। রাষ্ট্রীয় কাজে-কর্মে তোমার মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। তোমাকে আর এই নারীকে রুমবন্দী থাকা চাই। খেলাফতের কোন পরামর্শে তোমারা নাক গলাবার কে?
আমরা যা বুঝেছি করেছি। আবদুর রউফ বললেন, আমরা চলে যাচ্ছি। আমরা যদি কোন অন্যায় করে থাকি তাহলে আমাদের শাস্তি দাও।
উভয়েই আবদুর রহমান থেকে অনুমতি না নিয়েই চলে যেতে উদ্যত হলেন। আবদুর রহমান বললেন, দাঁড়াও! আমি শহীদানকে শ্রদ্ধা করি।
তারা থেমে গেলেন। তিনি তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলেন। চলনে তার সিংহের ক্ষিপ্রতা। সুলতানা ও যিরাবও ভড়কে যায় ওই চলনে। তাঁর যাবতীয় ক্লান্তি ও প্রভাব যেন উবে গেছে। তিনি বললেন, আমি এইমাত্র বিছানা থেকে গাত্ৰোস্থান করেছি। আলোচ্য ঘটনা আমি এতটা ভেবে দেখিনি।
জাগো আমীরে স্পেন জাগো, দুশমন জাগছে। তুমি ঘুমিয়ে থেকোনা, তাহলে গোটা স্পেনই মরণ ঘুমে ঢলে পড়বে।
তারা আমীরে স্পেনের বিবেকের রুদ্ধদ্বারে টাকা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
***
শার্সির কপাট ফাঁক করে আবদূল রহমান বাইরে তাকালেন। হাজেব আবদুর করীম ও সালার আবদুর রউফ শহীদানের লাশ ওঠাচ্ছেন।
ঈসায়ীদের লাশ ও জীবিত দুকয়েদী কি এখানে থাকবে? দারোয়ান জিজ্ঞেস করল।
আমীরে স্পেন যে হুকুম দেন তাই করো। আমরা স্রেফ শহীদানের লাশ নিয়ে যাচ্ছি।
আবদুর রহমান শহীদানের লাশ নিয়ে যেতে দেখলেন। প্রতিটি লাশ কাষ্ঠখণ্ডে শায়িত। চারজন করে সেপাই এদের বাহক। শহীদদের এ শব মিছিল মৌনতায় ভরপুর। উজির ও সালার সর্বপেছনে। এঁদের সম্মানে কোষমুক্ত তলোয়ার উঁচানো তাঁদের হাতে। ঘোড়া থাকতেও পদাতিক তারা। সামনে ডানে-বামে তলোয়ার উঁচিয়ে রাখা সেপাই। তাদের চাল-চলন ও গমন শোকের। ওরা তীব্রগতিতে চলছে। কেঁপে উঠছে যমীন। লাশবাহকদের চলায় গাম্ভীর্য বিদ্যমান। মামুলি চলছে তারা, যেন কাঁধে কিছু নেই।
আবদুর রহমান শার্সির ফাঁক দিয়ে এ দৃশ্য দেখে চলেছেন। তাঁর দৃষ্টির সীমায় শহীদী কাফেলার মৌন মিছিল। তার জোশ-জ্যবায় জোয়ার এল। টগবগ করে উঠল শিরার খুন। শাসির ফাঁক বন্ধু করে পেছনে ফিরলেন তিনি। তার দেহে নেই এক্ষণে সংগীত কিংবা সুলতানার আকর্ষণ। যিরা তাঁর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আনয়ন করেন। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বলেন,
ওরা যা করেছে ঠিক করা বোধ হয় ঠিক হয়নি। আমিও আমার ভুল স্বীকার করছি। আপনি তাদের গোস্তাকি আশা করি সহজে নেবেন না।
কেন সহজে নেব না? আবদুর রহমান প্রশ্ন করেন, বিশ্বস্ততার সাথে তারা স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছে। ওদের দরবারী রেওয়াজের বিরুদ্ধাচরণ হজম করেই ওদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখব। আর যিরাব! সুলতানা! তোমরা আগামীতে আমার উজির ও সালারের সামনে ওভাবে কথা বলবে না। এটা নিছক রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। এতে কোন কথা কিংবা সিদ্ধান্তের যিম্মা ওদের-তোমাদের নয়। রাজনীতি যারা বোঝে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কথা বলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেবল তারাই।
যিরাবের আপাদমস্তক ঝটকা মেরে ওঠল। সুলতানা তা দেখে মাথা নীচু করলো। আমীরে স্পেন তাকিয়ে বললেন, সুলতানা! আমার গোসলের ব্যবস্থা করে। এরপর ওই দুই খ্রিষ্টানকে আমার সামনে হাজির করো। চীফ জাস্টিসই ওদের বিচার করবেন। কিন্তু এর আগে জানতে চাই, ওদের উদ্দেশ্য কি!
সুলতানা কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। আবদুর রহমান গেলেন বেডরুমে। যিরাবও বেরিয়ে গেল। যাবার সময় সে সেপাইদের বলল, দুকয়েদীকে আমার কাছে সোপর্দ কর। সে ওদের নিয়ে আরেকদিকে চলে গেল এবং তাদের সাথে জরুরী আলাপে মশগুল হল।
***
গোসল সেরে আবদুর রহমান শাহী হলরুমে প্রবেশ করেন। তার সামনে খ্রিস্টান দুকয়েদী। যিরাবও আছে ওদের সাথে।
তোমরা সত্য উচ্চারণ না করলে এমন ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে-যার কল্পনাও করতে পার না। আবদুর রহমান বললেন, কে এই ভেল্কিবাজির উদগাতা? আমি এই পরিকল্পনার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। তবে সে শাস্তির কবল থেকে রক্ষা পাবে না। সত্য উচ্চারণ করলে তোমরা জানে বেঁচে যেতে পার।
কি অপরাধ আমাদের? দুজনের একজন ফরিয়াদী সুরে বলল, আমরা আপনার প্রজা। উজির ও সালারের মোকাবেলায় আমাদের কথাকে আপনি বিশ্বাস করবেন না-যদিও আমরা সত্যবাক। বাস্তবতা আরেক রকম। আপনার লোকেরা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ানো গির্জায় আগুন লাগিয়েছেন, যা হযরত ঈসা (স)-এর যুগে নির্মিত। একে আপনি বাংকার বললেও সেটা আমাদের কাছে এমন পবিত্র যেমন আপনাদের কাবা শরীফ। রাতে আমরা ওখানে এবাদত করতে যাই। আমরা যখন ইবাদতে লিপ্ত তখন আপনার সেপাই আমাদের ওপর অকস্মাৎ হামলা চালায়। আমাদের সকল লোককে হত্যা করা হয় কেবল আমরা বন্দী হই। যেহেতু এক্ষণে আপনার কয়েদী আমরা, এজন্যই আমাদের অপরাধী বলতে পারেন।
ইসলামের শিক্ষা কি এই যে, সংখ্যালঘুর ইবাদতগাহে হামলা চালানো হবে? অপর কয়েদী প্রশ্ন করল, এই ঈসা মসীহর ছবি ওখানে পড়ে আছে। আপনার সেপাইরা এটা উঠিয়ে এনে এখানে আছড়ে ফেলেছে। আমাদেরকে এভাবে প্রভাবিত করে মুসলমান বানাবেন-এই খেয়াল করে থাকলে তা বাস্তবায়িত হবে না কোন দিনও।
ইয়াহইয়া। আবদুর রহমান দরবারী জনৈক চাটুকার আলেমকে লক্ষ্য করে বললেন, আমার সালার ও উজিরের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারী করব? ওরা মিথ্যা বলছে বলে মনে করব?