আমরা আপনাকে তিরস্কার করব না। কিন্তু স্পেনে খ্রিস্টানরা এমন কিছু শুরু করেছে যাতে আমাদের ঘুম হারাম হবার উপক্রম। ওদের ভেল্কিবাজি ইসলামের উপর প্রভাব ফেলছে। ওরা স্রেফ খ্রিস্টানদের নয় মুসলমানদেরও বিদ্রোহী করে তুলছে।
ভীতিকর কোন ঘটনা ঘটেছি কি? আবদুর রহমান হাই তুলে বললেন, নাকি কোন সংবাদদাতার সংবাদ আমাকে শোনাতে এসেছেন?
আমীরে স্পেন! গতরাতে একটি ঘটনা ঘটে গেছে ইতিপূর্বেও যা ঘটে আসছিল। গত রাতে আমরা ওই ঘটনার যবনিকাপাত ঘটিয়েছি। বাইরে কিছু লাশ পড়ে আছে। তন্মধ্যে কিছু আমাদের করে বাদ বাকী খ্রিস্টানদের। ওদের জীবিত দুজনকে আমরা ধরে এনেছি। সিংহশাবক
লাশ! আবদুর রহমান চমকে ওঠেন, ব্যাপারটি কি এতই গুরুতর যে, রক্তারক্তি করতে হলো?
এ প্রশ্নের জবাবে সালার ও উজির পুরো কাহিনী শুনিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে যিরাব এসে হাজির। তিনি বড় এক নিমেষে রাতের ঘটনা বলে যাচ্ছিলেন। আবদুর রহমানের ঘুমের ঘোর কাটেনি তখনও। সালার আবদুর রউফ বললেন,
আমরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় মাননীয় আমীর। এ দুকয়েদীর খেকে শোনা যেতে পারে, কে এর নাটের গুরু! অচিরেই ওদের কারারুদ্ধ কিংবা জল্লাদের কাছে হাওয়ালা করা দরকার। তাদের বন্দী করা দরকার যারা এ কাজের হোতা। ওদের মেজাজ-মর্জি পরীক্ষা করা প্রয়োজন, যা এই ফেত্নর জন্মদাতা।
গোস্তাকি মাফ করবেন স্পেনরাজ! আবদুর রহমানের স্থলে যিরাব বললেন, শ্রদ্ধাভাজন উজির ও মান্যবর সালার যে কাজ করেছেন তা পরধর্মসহিষ্ণুতার বিরোধী। স্বাধীন ধর্মকর্মের প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল। ভেল্কিবাজি ধর্মের নামে কেউ করলে করুক- আমাদের ধর্মে এর কোন ঠাঁই নেই। ওদেরকে এ ধরনের ভিত্তিহীন কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া উচিত, যাতে জনতা বুঝতে পারে ইসলাম ও খ্রিস্টবাদের ফারাক। অচিরেই তারা জানতে পারবে ইসলাম কোন ভেল্কিবাজির ধর্ম নয়।
যিরাব! উজির গর্জে ওঠেন, আমরা আমীরে স্পেনের সাথে কথা বলছি তোমার সাথে নয়। হুকুম তার থেকে চাই-তোমার থেকে নয়। নয় মহলের সামান্য এক গায়ক থেকে। আমীরে মুহতারাম। এই ভেল্কিবাজি ইসলামের বিরুদ্ধে হচ্ছিল।
আমীরে স্পেন আবদুর রহমানের ভেতরটা সজাগ হয়ে উঠল। তিনি কোন আনাড়ি শাসক নন। জ্ঞানী ও কর্মঠ মর্দে মুজাহিদ। তার জ্ঞান গরিমার কথা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে। নারী ও সংগীতইও তাকে খেয়েছে। এর ওপর ঘুমের প্রকোপ। আবদুল করীমের গর্জন তার পৌরুষে আঘাত হেনেছে। তিনি যিরাবের দিকে ফিরে তাকান। সুলতানা নিছক এ উদ্দেশ্যেই যিরাবকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আবদুর রহমান বললেন,
যিরাব! তুমি চুপ থাক, ওরা ঠিকই বলেছে। হুকুম দেব আমিই।
যিরাবও খুব চৌকস। কুদরত তাকে অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন করেছিলেন। তার সুরে ছিল মাদকতা। কথায় যাদু। ঠোঁটে খেলে গেল মুচকি হাসি। তিনি বললেন, স্পেনরাজ! আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। সেই সাথে ক্ষমা চাচ্ছি মাননীয় উজির ও মান্যবর সালারের কাছে। আমি আপনাদের চেতনা বিরোধী কথা বলিনি। বলতে চেয়েছি স্পেনরাজ আপনাদের কৃতকর্মের জন্য সাধুবাদ দিন। তবে রাজাকে তার প্রজাদের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। আপনারা আজ বাদে কাল ক্ষমতায় এসে এমন চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। যদি স্পেনরাজকেও সেনাপতি বানানো হত তাহলে আপনাদের চেয়ে কঠোর হস্তে এই ফেত্নার মূলোৎপাটন করতেন তিনিও।
যিরাব চাতুর্যপূর্ণ যুক্তির বেড়াজালে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার বক্তব্য ঝেড়ে যাচ্ছিলেন। উপস্থিত শ্রোতাকুলে পিনপতন নিস্তব্ধ। আবদুর রহমান মন্ত্রমুগ্ধের মত গোগ্রাসে গিলছেন এই চাটুকারের বচন। তার ওপর আবার অর্ধনগ্ন সুলতানার রেশমী কোমল কুন্তলরাজি তার দেহে মাদকতার সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে। তার দেহে লাগছে নারী সৌন্দর্যের পিরামিডের উত্তাপ। ওর দিকে তাকালে স্পেনরাজের শ্বাস আর ওর শ্বাস একাকার হয়ে যেত। আরদুর রহমান বললেন, তোমরা যা করেছ-বেশ করেছে। ব্যাপারটা এখানেই চুকিয়ে ফেল।
এ সময় সুলতানা বললো, ওই দুকয়েদীকে যেন মুক্তি দেয়া হয়, যাতে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা যেন একথা বলতে না পারে যে, ইসলাম একটি প্রজাপীড়ক ধর্ম।
হ্যা! ওদের ছেড়ে দিতে হবে, আবদুর রহমান বললেন।
হাজেব আবদুল করীম গোস্বায় উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেন আবদুর রউফও।
আমীরে স্পেন? উজিরে আলা দরবারী রীতি উপেক্ষা করে বলতে লাগলেন, আপনি আরাম করুন। আমরা স্পেনে থাকি। আমরাই ইসলামকে জিন্দা রাখি। ইসলামের দেখুভাল ওইসব শহীদানই করে যাবে যারা বুকের তাজা খুন নজরানা দিয়ে আপনার দরজায় পড়ে আছে। যাদের আপনি এক নযর দেখারও প্রয়োজনবোধ করেননি।
আপনাকে দেখতে হবে না আমীরে মোহতরাম! খোদাতাআলাই ওদের দেখবেন। সালার আবদুর রউফ বললেন।
আপনারা শান্ত হয়ে বসুন! গোবেচারাস্বরে বললেন, আবদুর রহমান, আমি শুনে চলেছি। আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে।
স্পেন আপনার জায়গীর হলে আপনার অনুমতি ব্যতিরেকে আমরা শ্বাস ছাড়তাম না। এদেশ খোদাপ্রদত্ত। এদেশে ইসলাম কাউকে ভয় পেয়ে টিকবে না। কারো পরোয়া করবে না সে। ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে আমরা একপায়ে খাড়া। জীবনের শেষ ফোঁটা রক্ত দিয়ে হলেও এ মহতী কাজে আমরা পিছপা হব না।