গির্জা থেকে কারো দৌড়ানোর আওয়াজ শোনা গেল। সেপাইরা সেদিকে তাকাল। তারা দেখল, ঈসা (আ)-এর প্রতিচ্ছবি সম্বলিত কাষ্ঠলক নিয়ে দুখ্রিস্টান পালাচ্ছে। মুসলিম সেপাইদের আগুয়ান দেখে তারা দ্রুত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে লাগল, কিন্তু পারল না। মাঝপথেই হোঁচট খেল। এদের পাকড়াও করা হোল। গির্জায় তখনও ধোঁয়া উড়ছে। ফওরান ফানুস দেখে আলোক উদগীরণ হচ্ছে। গির্জার ছাদ কাঠের। আড়া ও বেড়াও কাঠের। সবগুলোতেই আগুন লেগেছে, ভয়াবহ এ আগুন নিভানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না, নেভানোর জরুরতও ছিল না।
***
কাষ্ঠ নিয়ে পলায়নকারীদের গির্জার পাশে নিয়ে আসা হোল। দরজা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। পুরোটা গির্জা তখন অগ্নিকুণ্ডে রূপান্তরিত।
এই রহস্যের দ্বারোম্মোচন করলে তোমাদের মুক্তি দেব। উজির বললেন, এটা তোমাদের ধর্মীয় ব্যাপার। কাজেই তোমাদের কারাগারে রাখব না। যে ভেল্কিবাজি দেখিয়েছে এর প্রতিও আমাদের কোন আপত্তি নেই, কিন্তু বলতে হবে এটা কি? নয়তো তোমাদের জ্বলন্ত গির্জার ইন্ধন বানাব। উভয়কে আগুনের এত কাছে আনা হলো যাতে তাদের চেহারায় তাপ লাগছিল। আগুনের তাপে ওদের চেহারা ঝলসে যাবার উপক্রম। ওরা দূরে সরতে চাচ্ছিল। দূরে সরানো হলো। ওদেরই একজন বলল, এর পেছনে কার হাত রয়েছে তা আমরা আপনাদের বলব না। জবরদস্তি করার চেয়ে আমাদের এই আগুনে ফেলে দেয়াই ভালো। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে, ধর্মের জন্য তারা জীবন দেবে।
ধর্ম সেখানেই গতিশীল যেখানে ধার্মিকরা তাদের নবীর নামে জ্বলতে পারে। ওদের অপরজন বলল,ইসলামী তরী ডুবন্ত, খ্রিস্টবাদ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। আমরা আমাদের টার্গেটে পৌঁছবই।
এ কথার জন্য ওদের ওপর কোন প্রকার শাস্তি না দিয়ে ধন্যবাদ জানানো হলো। এতে কোন সন্দেহ নেই, ওরা ছিল খুবই বুদ্ধিমান ও চৌকস। ওদের কথা হেলায় ফেলে দেবার মত নয়। ওরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল, সামনের প্রান্তরের ঘন বৃক্ষের তীব্র রশ্মিসম্পন্ন ফানুস জ্বালানো হত। এর ওপর গোলাকার প্লেট রাখলে আলো চারদিকে না ছড়িয়ে কেবল সম্মুখ দিকেই আছড়ে পড়ত। গাছে গোলাকার কাঠের রক রাতের আঁধারে ওই আলোতে চমকাত। যেহেতু ওই ব্লক সুতায় লটকানো, তাই বাতাসে হেলাদুলা করত। হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে প্রচলিত ছিল যে, তার নূর গাছে চমকায়, এই আকীদা অবলম্বনে তারা চলচ্চিত্র বানায়। সেটাই হচ্ছে আপনাদের জিজ্ঞাসার সদুত্তর। এই গির্জায় আমরাই আগুন লাগিয়েছি তাই এই কাষ্ঠলক নিয়ে পলায়ন করছি।
যে মুসলিম মুমূর্ষ সেপাই তর্জনী দ্বারা বৃক্ষের দিকে ইশারা করেছিলেন এই কাষ্ঠখণ্ডকেই বুঝিয়েছেন তিনি, যার ওপর ছায়া পড়ে। ওই সেপাই-ই রাতের বেলা এক লোককে গাছে ওঠানামা করতে দেখেছেন। সেই কাষ্ঠপ্লেট এখনও গাছে ঝুলছে। ওটি নামানো হলো। সামনের প্রান্তরে ফানুস নিতে গিয়েছিল। ওটি প্রজ্বলনকারীরা মরে পড়েছিল ওখানেই।
আমরা যা কিছু করেছি তা ধর্মের খাতিরেই। দুজনার একজনে বলল, আমাদের লোকেরা ইশারায় কথা বোঝে, তারা ইশারায় আমাদের বুঝিয়েছিল যে, জীবন গেলেও সত্যের দ্বারোদঘাটন করবে না। আপনাদের সাথে আমাদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। এটা দুধর্মের দ্বন্দ্ব। ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে-খ্রিস্টবাদ একে প্রতিহত করবেই। প্রতিহত করতে গিয়ে আমরা বৈধ-অবৈধ সবই করে যাব, আমাদের আগুনে ফেলে দিন। আমাদের ছাই ভষ্ম থেকে এমনও লোক জন্মাবে যারা আমাদের পথে চলবে।
১.৪ হুংকার
দিগন্ত প্রসারী অলোর বন্যা নিয়ে সূর্য উঠছে।
হাজেব আবদুর করীম ও সালার আঃ রউফ আবদুর রহমানের মহলে এসে পৌঁছলেন। তাঁদের সাথে মুসলিম-খ্রিষ্টান জানবাষদের লাশ। এমন কি হযরত ঈসার ছবি, কাষ্ঠলক ও প্লেটও, যা আলোতে চমকাত। সাথে ওই দুজীবিত খিস্টানও। তাদের আগমন বার্তা স্পেনরাজ আবদুর রহমান জানতে পারেন। তিনি এই মাত্র ঘুম থেকে জেগেছেন। পাশে সুলতানা। আবদুর রহমান তাকে পাশে থাকতে বললেন।
তারা উভয়ে হলঘরে বসলেন। আবদুর রহমান হেরেম থেকে বেরোলে, সুলতানা তার খাস খাদেমের মাধ্যমে যিরাবকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তাকে যে অবস্থায় পাও বলো, উজিরে আলা ও সালার এসেছেন। আবদুর রহমান হল ঘরে ঢুকলে তার সাথে সুলতানা থাকলেন। তিনি তখনও নাইট গাউন পরিহিতা। কাঁধ ও বাহুতে রেশমী কোমল চুল চকচক করছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তার যৌবনের কাঁচা অঙ্গ। কোন প্রকার প্রসাধনী নেই এ মুহূর্তে তার দেহে। দর্শককে যেন বলছে, দেখো! আমাকে প্রকৃতি নিজ হাতে গড়িয়েছেন।
স্পেনের উজিরে আলা ও সালার তার দিকে এক ন্যর দিয়ে পরস্পরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন। সুলতানাকে দেখে তারা কেমন যেন চমকে ওঠেন। চোখে চোখ রেখে তারা বললেন, আমাদের খুবই সজাগ হয়ে কথা বলতে হবে। কারণ কথার যাদুতে যে আবদুর রহমান মারা পড়েছে তাকে নতুন কথার যাদুতে জাগিয়ে তুলতে হবে। তার ভেতরকার পৌরুষকে জাগাতে হবে, যাতে মর্দে মুমিন হুংকার মারতে পারেন। নারীদেহের এই অশ্রুতপূর্ব হাস্য-লাস্যে কোন পুরুষের পক্ষে জীবিত থাকা সম্ভব নয়। আবদুর রহমান মৃত লাশে পরিণত। তাকে জাগিয়ে ভোলা এই মুহূর্তের প্রধান কাজ। উজিরে আলা কথা শুরু করলেন,