হামেদ আরাবী বৃক্ষের নিকটে ছিলেন। তিনি পায়ের আওয়াজ টের পেলেন। অন্ধকারে দুটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। ওদের একজন গাছে চাপল। নীচে দাঁড়ানো লোকটা বলল, ওই স্থানটা মনে আছে তো?
মনে আছে। গাছের ওপর থেকে আওয়াজ এলো।
দুতিনজন লোক হামেদের কাছ থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে গেল। পর মুহূর্তে চূড়া-প্রান্ত থেকে লঘু আওয়াজ শ্রুত হলো। উৎসুক জনতা সমবেত হল। ওদের সুরও স্ব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
মুহূর্তেই প্রান্তরে স্থাপিত দেয়াল আলোকিত হয়ে উঠল। হামেদ খুব ধ্যান-খেয়ালের সাথে তাকিয়ে দেখলেন, বড় সাইজের একটি ঝাড় ফানুস এর আলো কেবল সামনে ঠিকরে পড়ছে। ডানে-বামে, উপরে কিংবা নীচে পড়ছে না। হামেদ দেখলেন, গাছে চড়া লোকটা নেমে আসছে। নীচে যে লোকটা ছিল সে চলে গেছে। তিনি লঘু পায়ে অগ্রসর হলেন এবং তার বুকে বর্শা ছুঁয়ে বললেন, আবার গাছে চড়, উপরে যা রেখে এসেছে তা নিয়ে এসো।
লোকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, কে তুমি?
যা বলছি তা কর। হামেদ বললেন।
বর্শা সরাও। উপরে যাচ্ছি।
লোকটা গাছে চড়তে লাগল। বিদঘুঁটে অন্ধকার। হামেদ দেখতে পাচ্ছেন না, লোকটা কি করছে। তিনি তলোয়ার বের করলেন। লোকটা গাছে সামান্য উঠে ঠুস করে নেমে খঞ্জর বের করে হামেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি নিজকে বাঁচাতে পারলেন না। খণ্ডরের ডগা তার বাহুতে ঢুকে গেল। হামেদ মুহূর্তে বাঁ হাতের বর্শা লোকটার পেটে ঢুকিয়ে দিলেন। লোকটা আর্তনাদের সুরে কারো নাম ধরে ডাকল। হামেদও তার লোকজনকে ডাকলেন। ওদিকে যে আলো জ্বলছিল তা হামেদ ও তার লোকজনের দিকে বিচ্ছুরিত শুরু করল। গির্জার ভেতর থেকে কলোক দৌড়ে বেরোল। সকলেরই হাতে খোলা তলোয়ার। হামেদ তার লোকজনকে আত্মগোপন করতে বললেন। নিজেও আত্মগোপন করলেন। গির্জা থেকে আগুয়ান লোকেরা সংখ্যা বেশ। তাদের সাথীকে বৃক্ষের নীচে পতিত দেখতে পেয়ে আশেপাশে তল্লাশি শুরু করল। আততায়ী মুহূর্তে গেল কৈ?
একলোকে হামেদের কাছে পৌঁছে গেল। বসা অবস্থায় তার পার্শ্বদেশে তিনি বর্শা ঢুকিয়ে দিলেন। তার মুখ থেকে নির্গত বিশেষ আওয়াজে অন্যান্য সাথীরা দৌড়ে এল। ওদেরই কেউ চিৎকার দিয়ে বলল, আলো এদিক ফেরাও।
হামেদ যখমী ছিলেন। তাঁর সঙ্গী মাত্র দুজন। তারা সকলে ওদের নযরে পড়ে গেলেন। হামেদ রহীমকে ডাকলেন এবং এদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। ওরা এদের তিনজনকেই ঘিরে ফেল। ওদিকে রহীম তার লোকজন নিয়ে স্পটে এসে পৌঁছলেন।
পাহাড়ের পাদদেশে যখন সমবেত জনতা তারকা দীপ্তির অপেক্ষা করছে, এদিকে তখন দীপ্তিকারীরা জীবন-মৃত্যুর দোলনায় দোল খাচ্ছে।
১.৩ শেষ রাত
হাজেব আবদুল করীম যখন ঘুম থেকে গাত্রোত্থান করেন তখন সহসা কেউ তার দরজায় করাঘাত করল। তিনি খুলে দেখলেন তাঁর জনৈক চাকর দণ্ডায়মান। সে বলল, বাইরে যমী একলোক আপনার অপেক্ষায়। আবদুল করীম দৌড়ে বেরোলেন। দারোয়ান যমীকে শুইয়ে দিয়েছে। রহীম গাযালীই সেই যখমী। তার কাপড় রক্তে লাল। জীবনের আখেরী দম নিচ্ছিলেন তিনি। ত্বরা করে হেকিম ডাকতে নির্দেশ দিলেন তিনি, কিন্তু রহীম তাকে বারণ করলেন।
হেকিম আসা পর্যন্ত বোধ হয় আমি জীবিত থাকব না। রহীম গাযালী কাতরাতে কাতরাতে বললেন, আমার আখেরী কথাগুলো শুনুন। আমার কোন সাথী ফিরে এলে মনে করবেন সকলেই শাহাদাঁতের সুমিষ্ট শরাব পান করেছে। বাস্তবিকই ওটা ছিল ভেল্কিবাজি। ওদের দুএকজন হয়ত বেঁচে আছে। আপনি ফরান গির্জায় যান। ওখানে লাশের দেখা পাবেন। গোটা রহস্য ওখানে গেলেই উদ্ধার করতে পারবেন।
তিনি অতি কষ্টে কথাগুলো আওড়ান। এ সময় তিনি দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছিলেন। এই খাস এক সময় গোঙানীতে পরিণত হল। হেকিম এসে পৌঁছালেন, কিন্তু তার আগেই রহীম তার আখেরী শ্বাস টেনে প্রভুর দরবারে চলে গেলেন। হাজেব মনে মনে বললেন, না এদের খুন বৃথা যেতে দেব না।
শিরা-উপশিরার খুন তাঁর টগবগিয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত পিষলেন তিনি। কর্মচারীরা বললেন, সালার আবদুর রউফকে ডেকে পাঠাও। তাকে যে অবস্থায় পাও এখানে নিয়ে এসো।
আবদুর রউফ খুব একটা দুরে ছিলেন না। তিনি এসে গেলেন। তিনি রহীম গাযালীর আখেরী কথাগুলো তাকে শোনালেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ২০/২৫ জন ফৌজ প্রস্তুত করলেন। তিনি ও উজিরে আলা পৃথক দুটি ঘোড়ায় চাপলেন। যেহেতু তখনও আঁধার তাই সাথে মশাল নিলেন। সাথে এমনও এক লোককে নিলেন যে ওই এলাকাটা চিনত।
বিরান গির্জায় গিয়ে তারা দেখলেন, আলো জ্বলছে তখনও। জ্বলছে ঝাড়-ফানুসও। কোন লোকজনের দেখা নেই। দেয়ালের পাশে একটি কাষ্ঠলক পতিত। ওতে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিচ্ছায়া। প্রতিচ্ছায়া ওই আলোতে চমকাচ্ছে। বাইরে বৃক্ষের তলে বিক্ষিপ্ত লাশ। মুসলিম-খ্রিস্টান সবারই লাশ। তারা লাশ শনাক্ত করতে পারলেন। আচমকা একটি মুসলিম লাশকে নড়তে দেখা গেল। সালার আবদুর রউফ তার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন ও বললেন, ভয় নেই তোমাকে চিকিৎসা করলে সেরে উঠবে। তার পেট ফাড়া। সালারকে দেখে তার ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু কথা বলার শক্তি তখন তার নেই। তিনি আস্তে আস্তে উপরে হাত ওঠালেন। তর্জনী বৃক্ষের দিকে। আবদুর রউফ বললেন, ওখানে কি? ওদিকে আবারো তর্জনী উঁচিয়ে তিনি ঢালে পড়লেন। পরে প্রতিটি লাশই পরীক্ষা করা হলো, কিন্তু কারো দেহে প্রাণ ছিল না।