***
রহীম গাযালী ও হামেদ আরাবী উজির আবদুর করীমের বাসভবনে যান। তাদের দেখা কাহিনী বর্ণনা করেন। বলেন, এটা কোন ভেল্কিবাজি হতে পারে না।
আবদুল করীম বিজ্ঞ উজির ছিলেন। তিনি আচমকা প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি কেবল ওই চমক দেখছিলে, না কি আশে পাশেও ঘুরেছিলে?
তারা জানালেন, যখন তারকার চমক শেষ হয়ে যায় তখন গির্জার বিপরীত দিকের নীচে কোথাও আগুন জ্বলছিল। পরে এই আগুনও নিভে যায়।
এটা ভেল্কিবাজি। অলৌকিকতা নয়। নয় যাদুও। খ্রিস্টানদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে আমাদের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। এটি নও মুসলিমদের পুনরায় খ্রিষ্টান বানানোর প্ল্যান। তোমাদের দুজনকেই এটি খতম করতে হবে। যে আওয়াজ তোমরা শুনেছ, গির্জায় যাও তাহলে বুঝতে পারবে-কি মুসিবত আসছে। আমার যদুর বিশ্বাস, এ আওয়াজ এই দুনিয়ার মানুষেরই মেকী আওয়াজ। কাল নাগাদ আমার কানে আসবে, ওইসব লোককে পুনরায় কি বলতে বলা হয়েছে।
পরের রাতে হাজেব আবদুল করীমের কাছে চার/পাঁচজন লোককে বলতে শোনা গেল, আজ গির্জায় এত ভীড় ছিল যে, উঁচ রাখারও জায়গা অবশিষ্ট নেই। পাদ্রীরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার তুলেছে। স্পেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে এমনও কথা বলেছে, যা শুনলে গা শিউরে ওঠে। তারা বলেছে, এই প্রশাসনের বিরুদ্ধাচরণ ধর্মের-ই কাজ। বিদ্রোহ জরুরী। তারা ঈসা (আ)-এর আবির্ভাব জোরালো ভাষায় সমর্থন করে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করেছে। জনতা যখন গির্জা থেকে বেরোয় তখন সকলের মনে ভীতিভাব।
আবদুল করীম পরদিন সালার আবদুর রউফকে বললেন, আবদুর রহমানকে না জানিয়ে এই ভেল্কিবাজির রহস্যোদ্ধার করতে হবে। তিনি ওই মুহূর্তেই রহীম ও হামেদকে ডেকে পাঠালেন। ডেকে পাঠালেন আরো চার লোককে। বললেন, আমরা তোমাদেরকে অগ্নি পরীক্ষায় পাঠাচ্ছি। আমরা জেনেছি, হযরত ঈসা (আ)-এর আবির্ভাব সম্পূর্ণ বানোয়াট। যখন তথাকথিত ওই তারকা চমকায় ও মানুষের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি হয় তখনই লোকসম্মুখে একে চুরমার করে দিতে হবে। তোমরা সতর্ক থাকবে। যে রাতে তোমরা শুনবে ঈসা (আ) আবির্ভূত হচ্ছে, সে রাতে তোমরা উঠানে উপস্থিত থাকবে। তবে জনতার কাতারে নয় থাকবে বিরান গির্জার নিকটে, ওখানেই তোমরা উদ্ধার করতে পারবে কোত্থেকে আসছে তথাকথিত এই তারকা চমক।
কোথাও না কোথাও দেখবে আগুন জ্বলছে। এমন স্থান থেকে আগুন জ্বলছে, যা মানুষের নজরে পড়ছে না। খুব সম্ভব দুএকজন লোক এ কাজে জড়িত। ওদের ওপর আক্রমণ করে আগুন আয়ত্তে আনবে। এর পূর্বে তোমরা দুজন গির্জার পাশে ওঁত পেতে থাকবে। লক্ষ্য করবে, কে কথা বলে। তাকে পাকড়াও করবে। তোমাদের সাথে খঞ্জর ও বর্শা থাকা চাই। ওদের সাথে লড়াই করতে হতে পারে। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে কাউকে জীবিত রাখবে না। পরে তোমাদেরই একজনকে ভেল্কিবাজি ও প্রতারণা বলে একে ঘোষণা করতে হবে। বলতে হবে, ওখানে কোন ঈসার আবির্ভাব ঘটেনি। আর আমরা বিরান গির্জা জনতাকে নিয়ে দেখাব। দেখাব সে জিনিষও যা বৃক্ষে চমকাত।
উজির ও সালার তাদেরকে এই অভিযানের বিস্তারিত সব কিছু বুঝালেন। সবশেষে বললেন, এই কাজের প্রতিদান আল্লাহ-ই দেবেন। আমি আবারও বলছি, এ অভিযান সহজ নয়। কুশ পূজারীরা পাক্কা বন্দোবস্ত করেই রেখেছে। তোমাদের জীবন হুমকির মুখে মনে করতে পার। আমি তোমাদের হুকুম দিচ্ছি না। তোমরা যেতে না চাইলে কোন প্রকার প্রতিশোধ নেব না। এমন কি রাগও করব না। ধর্ম ও জাতির অতন্দ্র প্রহরী তোমরা। এদেশ কোন খান্দান বিশেষের নয়– তোমাদের। তোমাদের ঘরে ডাকাত পড়লে তোমাদের বাপ-দাদারা, ওদের ছেড়ে দিলেও তোমরা কি নিশ্চুপ থাকবে?
স্পেন তোমাদের ঘর। ঘর আমাদের সকলের। শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে হাজেবের চোখে পানি এসে গেল।
আমরা যে কোন কোরবানী দিতে প্রস্তুত। আমরা প্রস্তুত-এদের একজন বললেন।
আমরা কারো থেকে কোন প্রতিদান চাইব না।
খোদা তায়ালার কাছেও কোন প্রতিদান চাইবো না।
ছ’ছজন জানবায প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন।
***
দুরাত পরেই খবর এলো, আজ কিছু নযরে আসবে। ওখানে যে-ই যেতে চায় সে যেন গোসল করে যায়। মসজিদ মসজিদে এলান করা হয়, কোন মুসলমান যেন না যায়। ছজন জানবার্য পরিকল্পনামত রওয়ানা দিলেন।
রহীম, হামেদ ও চার সেপাই সূর্যাস্তের পর পরই তারা ওখানে উপনীত হলেন। দিনের বেলা ছদ্মবেশে প্রথমোক্ত দুজন এলাকাটা সফর করে এসেছেন। পাহাড়ে উঠেও তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। আঁধার রাতে এই ছমুজাহিদ পাহাড়ের কোন এক প্রান্ত দিয়ে ওপরে চড়লেন। ওপরে ওঠার পথ কয়েকটা। চূড়ায় সামান্য সমতল ভূমি। এখান থেকে আরো উপরে ঢালু আছে। পাহাড়ী ঘাসে ওই ঢালগুলো ঠাসা। স্থানটা খুবই ভীতিজনক। ওখান থেকে একটি ঝর্ণা নীচে নেমে গেছে অবিরাম ধারায়।
রহীম গাযালী দুসেপাই সাথে নিলেন এবং বাদবাকী দুজনকে হামেদের সাথে দিলেন। সকলের হাতেই বর্শা ও খঞ্জর। সকলে গেলেন পৃথক হয়ে। রহীম তার দুসাথী নিয়ে গির্জার পাশে ওঁৎ পেতে থাকলেন। আর হামেদ তার দুসাথীসহ ওই বৃক্ষের কাছে গেলেন যেখানে ভৌতিক তারকা চমকাত।
আঁধার জমকালো রূপধারণ করলে রহীম গীর্জার নিকটে সে ধরনের আওয়াজ শুনতে পেলেন। পরমুহূর্তেই গির্জার আলো জ্বলে উঠল, যা শার্সির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। গির্জার কপাট খুলে কজন বলল, গোটা সরঞ্জামাদি শেষবারের মত পরখ করে নাও। আরেকজনে বলল, আমরা সবকিছু দেখে নিয়েছি। তোমরা গাছে চড়। উৎসূক জনতার আগমন শুরু হয়েছে। পরে আরেকজন বলল, মানুষের চিন্তা করোনা। ওরা উপরে আসছে না।