মানুষেরা আসত টিলার পাদদেশে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। মানুষের কানাঘুষা আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। নেমে এল কবরের নিস্তব্ধতা। সামনের পাহাড়ের ঢালের একটি বৃক্ষে তারকা চমকে উঠল। এখনও একটি প্রবাদ খ্রিস্টান সমাজের প্রচলিত আছে যে, বৃক্ষে তারকাকৃতিতে ঈসা (আ) আবির্ভূত হন। আসমানের তারকার মতই ওটি ঝিকমিক করে।
গির্জা থেকে সমবেত কণ্ঠের গান-বাজনা শ্রুত হলো। রীতিমত গীতবাদ্য। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে এই গীত যাদুকরী আকর্ষণ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। সকলে সামনে পিছে নজর বুলিয়ে বুকে হাত রেখে ঈসা (আ)-এর উপস্থিতি অনুধাবন করে যেতে লাগল। সকলেই ওই গীত মুখে উচ্চারণ করল। তারকাটি দুলছে ও এর কিরণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ক্রুশ পূজারীবৃন্দ। জলদগম্ভীর একটি কণ্ঠে সকলে চমকে উঠল, ঈসা মসিহর ভক্তবৃন্দ। আমি বাণী নিয়ে এসেছি। পতন তোমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। একে রুখখা। রুখবার শক্তি আছে তোমাদের। ঈসা কুষ্ঠরোগকে উপশম করতেন কিন্তু ওরা কুষ্ঠ ছড়াচ্ছে। তোমাদের যারা খ্রিস্টধর্ম ছেড়েছে তারা পুনরায় স্বধর্মে ফিরে যাও নয়তো সকলকে কুষ্ঠ রোগে ধরবে।
তারকাটি অদৃশ্য হয়ে গেল। জমকালো আঁধারে ঢেকে গেল পরিবেশ। সমবেত মানবের মাঝে নেমে এল কবরের নিস্তব্ধতা। পরে ওই পাহাড় থেকে বিশেষ আওয়াজে সকলের চমক ভাঙ্গলো। একটি কণ্ঠে ঘোষণা হলো, এবার তোমরা স্বগৃহে ফিরে যাও। নিজস্ব আমলের প্রতি সতর্ক থেকে। কাল আবারো এসো। আবির্ভাব আবারও হতে পারে।
মানুষেরা ভয়ে ভয়ে বাড়ীর পথ ধরল।
***
এ ঘটনা উপস্থিত শ্রোতামগুলীর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকল না। ওই যুগ ছিল নিরক্ষরতার যুগ। লেখাপড়া জানত না মানুষ। জনশ্রুতিকে ওহী জ্ঞান করত। এ ধরনের কথা তারা অন্তরের অন্তঃস্থল দিয়ে শুনত ও পরে তা মানুষের কাছে বলত। তখন এতে বেশ কিছু কথা মিশ্রণ করে দিত। হযরত ঈসা (আ)-এর সাহাবীর আবির্ভাব-তাও আবার তারকাকৃতিতে-এমন এক মোজেযায় রূপ নিল যে, যাকে দেখার শখ জাগল সকলের মনে। মুসলমানরাও যেতে প্রস্তুতি নিল।
মসজিদে মসজিদে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল। মুসল্লীরা ইমাম ও মৌলবী সাহেবানদের জিজ্ঞেস করতে লাগল, এ ঘটনা কতটুকু সত্য। বিজ্ঞ ইমামবৃন্দ একে কৃত্রিম বলে এর ওপর বিশ্বাস আনতে নিষেধ করলেন। এটা প্রকাশ্য কুফর। আমাদের ধর্মের ওপর চুনকালি মাখতে খ্রিস্টানরা নিরর্থক এক নাটক মঞ্চায়ন করছে। এটি বানোয়াট, উদ্ভট ও বিভ্রান্তিকর।
এটা কোন ভেল্কিবাজিও হতে পারে। জনৈক বিজ্ঞ আলেম এই ফতোয়া দিলেন। তিনি আরো বললেন, কোন মুসলমান একে দেখতে গেলে শেরকের গোনাহ হবে।
***
ঈসা (আ)-এর শিষ্য তারকা আকৃতিতে আবির্ভূত হয়েছেন-এ কথার সত্যাসত্যের জন্য দরকার ছিল ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার। এটা কোন ভেল্কিবজি কি-না। কি এর নেপথ্যে রয়েছে? এতে কোন সন্দেহ এই যে, খ্রিস্টানরা নাশকতামূলক, বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছিল কিন্তু এ সময় আলেম সাহেবরা শিরক ফতোয়া দিয়ে ব্যাপারটি তদন্তের পথ বন্ধ করে দিলেন।
সেনাপতি উবাইদুল্লাহ তখনও কর্ডোভা পৌঁছাননি। উজির হাজেব ও আবদুর রউফ পরস্পরে আলাপ করছিলেন, ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখা উচিত। খ্রিস্টানেরা মুসলিম মনকে বিভ্রান্ত করাতে ধূম্রজাল সৃষ্টি করেনি তো! তারা অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, আবদুর রহমানকে জানানোর পূর্বে আমরা তদন্ত করে দেখতে চাই।
ওদিক খ্রিস্টানরা গোটা শহরে ব্যাপারটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দিল।
আবদুল করীমের দুরহস্যভেদী রহীম গাযালী ও হামেদ আরাবী পরের রাতে খ্রিস্টানদের সাথে ওখানে গেলেন। এখানে মুসলমানরা খুবই কমই হাজির হয়েছে। কেননা ওখানে না যাওয়ার প্রতি মসজিদে মসজিদে ফতোয়া ঝেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই রাতটিও ছিল জমকালো। দুপাহাড়ের মাঝখানে অন্ধকার আর। উৎসুক জনতার ঠাসাভীড়। আচমকা সেখানে গীতবাদ্যের আওয়াজ গুঞ্জরিত হল। জনতার মাঝে পীন পতন নিস্তব্ধতা। খানিকবাদে পাহাড়ের চূড়ায় একটি তারকা চমকে উঠল। সিংহশাবক বেশ কিছু কষ্ঠ সেই সাথে গীত গেয়ে ওঠল। এই গীত প্রতিটি গির্জার খ্রিস্টানরা গেয়ে ওঠে। জনতার মাঝে এই গীত গুঞ্জরিত হল।
তারকা এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। বিস্ময় বিস্ফোরিত লোচনে সকলে এ দৃশ্য দেখল। তারকার দীপ্তি গির্জা চূড়ায়ই দেখা গেল, সাধারণতঃ যেখানে কুশদণ্ড স্থাপিত থাকত। দুই-আড়াই গজ দীর্ঘ ছিল এই চমক। এর মধ্যে কুশের ছায়াচিত্র দৃশ্যায়িত হত। জনতার ভীড়ে কান্নাকাটি শোনাগেল। সকলেই হাঁটু গেড়ে বসে গেল এবং পবিত্ৰগীত তাদের মুখে। রহীম গাযালী ও হামেদ আরাবী বসলেন না। তারা মুখ-চাওয়া চাওয়ি করে বললেন, এটা কোন ভেল্কিবাজি হতে পারে না। পরে তারা কেমন একটা মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে গেলেন। মনে হলো কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের বসিয়ে দিয়েছে। তারা খ্রিস্টানদের রহস্যপূর্ণ গীত জানতেন না। তাই মনে মনে কালেমা-ই তাইয়্যেবা উচ্চারণ করতে থাকেন।
গীত উচ্চারণ আস্তে আস্তে থেমে এলো। তারকার দীপ্তিও ম্লান হলো, যাতে ঈসা (আ)-এর অবয়ব দৃশায়িত ছিল।
এই হতাশ রূহ তোমাদের সতর্ক করছে। দূর থেকে একটি আওয়াজ ভেসে এলো, স্বধর্ম ত্যাগ করো না। তোমরা বুঝতে পারছ না গোনাহর শাস্তি কি! যে যমীনে গির্জা বিরান হয়ে যায় সে যমীন মানুষের বসবাসের যোগ্য থাকে না। গির্জায় যাতায়াত কর। সেখানে তোমাদের করণীয় কি তা বুঝিয়ে দেয়া হবে। বলা হবে সম্ভাব্য মুসিবতের কথা। একতা ও সততা বজায় রেখ। তোমাদের একতায় চিড় ধরছে। তোমাদের যারা মুসলমান হয়েছে তারাও গির্জায় যাবে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তওবা করবে। তোমাদের দেশে ঈসা মসীহের নূর বিচ্ছুরিত কর।