আর আমি আপনাকে করি মূল্যায়ন। স্যালাস সেনাপতিকে একথা বলে অনুসন্ধানী বাহিনীর প্রধানকে বলল, হত্যা করতে হয় তো তোমাদের বাদশাহকেই করো। তাকেই বাদশাহ বানাও যে স্বার্থোদ্ধারে অন্ধ নয়।
খানিক পরে স্যালাস ঘোড়ায় চেপে অদৃশ্য হয়ে যায়।
***
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, খ্রিস্টানরা স্পেন সাম্রাজ্যকে পতনের চোরাবালিতে আছড়ে ফেলেছিল। তাদের মধ্যে ধর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ওদের এলোগেইছ ও আইলিয়রেরা এবং পাত্রীসমাজ এমনভাবে অগ্রসর হচ্ছিল যাতে কাউকে মুসলিম গোয়েন্দা কিংবা টহলদার বাহিনীর সামনে পড়তে না হয়। ওদের প্রথম টার্গেট ছিল মুসলিম তাহযীব-তামাদুনের ওপর, যাতে ভোগ, বিলাসিতা ও ইবাদতবিমুখতা নিহিত। একদিকে উবায়দুল্লাহর মত জানবায সিংহশাবকেরা যখন ইসলামের নামে ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন অন্যদিকে তখন প্রাসাদে নারীকণ্ঠের কলকাকলী আর সংগীতের টুং টাং শব্দমজুরীতে ভূমিকম্পের রেশ তৈরী হচ্ছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, আবদুর রহমানও সালার ছিলেন। ছিলেন সমকালীন বিশ্বের নামজাদা যুদ্ধংদেহীও কিন্তু নারী ও সংগীতের কোপানলে পড়ে আপনার পরিচয় গিলে ফেলেছিলেন তিনি। কবি ও কাব্য-চর্চায় ছিল তাঁর অকৃত্রিম শখ। তারপরও তার সত্তা যেন অন্যের কজায় ছিল।
কাব্য চর্চা আর কবিগানের আসরই স্পেনকে ডুবিয়েছে। দরবারী চাটুকাররা বাদশাহর মেজাজ-মর্জির বিরুদ্ধে কথা বলত না। উপরন্তু তারা বাদশাহকে কথার আফিমে মত্ত রাখত। ইতিহাস লিখেছে, বনী উমাইয়ারা চাটুকারদের দরবারী আমলা বানাত। দেশ ও জাতির হিতাকাক্ষী ন্যায়-নিষ্ঠ লোকদের তারা চিনত, কিন্তু তাদের থেকে সযতে দূরে থাকত। মন্ত্রী ততক্ষণ মন্ত্রীত্বে থাকত যতক্ষণ সে বাদশাহর দৃষ্টিতে প্রিয়পাত্র থাকতে পারত। এসব রাজা-বাদশাহরা যেহেতু ক্ষমতাকে পারিবারিকীকরণ করতে চাইত সেহেতু শহর-বন্দরের প্রভাবশালী লোকদের দরবারে ঠাই দিত। এজন্য তারা দুহাতে খাজাখির ধন খরচ করত। মন্ত্রী, আমলা ছাড়াও দেশের কবি, বুদ্ধিজীবীরাও চাটুকারদের খাতায় নাম লিখিয়ে সরকারী ভাতা ভোগ করত।
স্পেনের ঐতিহাসিকবৃন্দ এসব চাটুকার কবি ও বুদ্ধিজীবীদের দোষ দিতে গিয়ে বলেছেন, এরাই তদানীন্তন শাসকদেরকে ডুবিয়েছে, আত্মতুষ্টিতে ভুগিয়েছে। পরিণতিতে পতন শুধু স্পেনিয় মুসলিমদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি পতনের এই ধারাবাহিকতা ইসলাম পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। উন্নয়নের সিঁড়িতে পা কেবল সে জাতিই রাখতে পারে যারা পূর্বসূরিদের বিভ্রান্ত পথ ও মত এড়িয়ে চলে।
স্পেন বিজয় নাটকে আজো ফ্লোরা কাহিনীর নাট্যরূপ দেয়া হয় এবং তাকে কোন না কোন মুসলমানের প্রতি অনুরাগী বানানো হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই ফ্লোরারাই সুলতানার মত সুন্দরী ছিল যারা উপর দিয়ে মুসলিম অনুরাগী থাকলেও তলে তলে ছিল কুশ পূজারী। এ সেই ফ্লোরা যাকে চীফ জাস্টিসের কাঠগড়ার ওঠানো হয়েছিল এবং একেই আজ প্ৰেমজগতের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারিনী সাব্যস্ত করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় আবদুর রহমানের যুগে খ্রিজাতি চারদিক দিয়েই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াচ্ছিল অথচ তিনি শরাবের মটকায় জাতির ভাগ্যতরীকে ডুবিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশ্য এ সময় কিছু জাত্যাভিমাণী মুসলিম সন্তান ন্যায় নিষ্ঠার সাথে ইসলাম নামের বৃক্ষটির গোড়া বুকের তাজা খুনে সিঞ্চিত করছিলেন। অনেকে ইসলাম প্রচারের মাধ্যমেও এ কাজ করে যাচ্ছিলেন। এদের দাওয়াতে কিছু মানুষ আন্তরিকভাবেই মুসলমান হয় আর কিছু হয় নামকাওয়াস্তের।
***
আচমকা একদিন কর্ডোভায় এ খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, এখান থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরে একটি উপত্যকায় হযরত ঈসা মসীহ (আ)-এর বিশেষ এক শিষ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। ওখানকার সমতল প্রান্তরে একটি বৃক্ষের ওপর একটা তারকা চমকাচ্ছে, সেইসাথে ওই শিষ্যের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
ওখানে একটি প্রাচীন গীর্জা ছিল। ওটি উঁচু প্রান্তরে নির্মিত। বিগত কোন যুগের বসতি যা আজ পোডড়াবাড়ীতে রূপান্তরিত। খ্রিস্টান সমাজে প্রচলিত ছিল, এখানে দুষ্টু আত্মার সদম্ভ বিচরণ রয়েছে। বড় ভয়ানক কাহিনী এ গীর্জা অবলম্বনে যার শ্রুতি রয়েছে। অনেক বলত, এটা দুষ্টু আত্মা নয় বরং ঈসা (আ)-এর যুগের নেক শিষ্যদের পুণ্যাত্মা। সম্প্রতি ওখানে এ নিয়ে বেশ রটনা, আলোচনা ও পর্যালোচনা। সর্বশেষ এই খবর বেরোল, এখানে তার এক শিষ্যের আবির্ভাব।
মানুষেরা ভয়ে ওদিক তেমন একটা যেত না। কিন্তু পাদ্রী সমাজে এই আলোচনা শুরু হলে দু একজন মানুষ যাতায়াত শুরু করে নিতান্তই কৌতূহলবশে। ওখানে যখন মানুষের আনাগোনা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় তখন গীর্জাসংলগ্ন বৃক্ষে তারকা চমকাতে শুরু করে। ওখানে গির্জা আর বৃক্ষের মাঝে একলোককে ঘোষণা করার জন্য দাঁড় করিয়ে দেয়া হত। ভয় নেই, তারকা চমকালে ঈসা মসীহকে স্মরণ কর বলে সে এলান করত।
ওই সময়কার রাতগুলো খুবই জমকালো হত। মধ্যরাতের পর চাঁদ উঠত। কোন এক রাতে লোকজনকে দুপ্রান্তের মাঝে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। তাদের সামনে একটি সমতল ভূমি, পেছনে উঁচু পাহাড় যা ঘন ঝোঁপ-ঝাড় আর বৃক্ষে ঠাসা। এরই মাঝে গীর্জাটি স্থাপিত। যাতায়াতের জন্য একটিমাত্র রাস্তা। যাতায়াত না থাকার কারণে সেটিও ঝোঁপঝাড়ে পূর্ণ। পাহাড়ের বুক চিরে কখনও বেরিয়ে আসত ঝর্ণা। এখন ওখানে প্রকাণ্ড এক জলাশয়। যেখানে জন্ম নিয়েছিল ছোট আকৃতির কুমীর। মানুষের আনাগোনা বন্ধের কারণ এও হতে পারে। আশেপাশে ছোটখাট টিলা।