গীর্জাভ্যন্তরের সেই বাংকার সেনাছাউনি থেকে মাইল তিনেক দূরে। আগন্তুকদ্বয় অগ্রে অশ্বপৃষ্ঠে চলছিল। সালার দেহরক্ষীসহ এদের পেছনে। বাংকারের কাছে আসতেই নারীকন্ঠে কান্না শোনা গেল। ঘোড় সওয়াররা থমকে দাঁড়াল।
সামনে যাবেন না। তম্মধ্যে একজন বলল, এদের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। জিন-ভূত মনে হচ্ছে। ওরা কাঁদবে কেন? অত্যাচারিত হওয়ার মত কোন কথা তো ওরা আমাদের গোচরে আনেনি!
ভেতরে চিৎকার শোনা গেল বাঁচাও! জালেমদের কবল থেকে উদ্ধার কর! আগন্তুকদ্বয় তলোয়ার হাতে অশ্বপৃষ্ঠ হতে নেমে এল এবং বাংকারের দিকে এগিয়ে গেল। দেহরক্ষী দুজনও ওদের অনুসরণ করল। আগন্তুকরা ফিরে এসে বলল, চিৎকার থেমে গেছে। তারা সালার ও দেহরক্ষীদের বাইরে থামিয়ে এ কথা জানাল কিছু না! এমনিতেই ওরা কান্নাকাটি করছিল।
দেহরক্ষীরা বাইরেই থাক। আপনি ভেতরে যান। জরুরী কোন কথা হবে হয়তবা। এরা নিরিবিলিতে আপনার সাথে কথা বলতে চায়। আগন্তুকদের একজন বল।
উবাইদুল্লাহ ভেতরে গেলেন। উবুজুবু হয়ে পড়া ভগ্ন ছাদের নীচ দিয়ে তিনি এগিয়ে চলছেন, ভেতরে কেমন একটা উৎকট গন্ধ। উবাইদুল্লাহ কামরার ভেতরে প্রবেশ করলেন।
এখানে কোন নারী নেই। উবাইদুল্লাহ কোষ থেকে তরবারী বের করলেন। কামরাটিতে ৪টি দরজা। তম্মধ্যে একটি খোলা, ওই পথে তিনি তাকালেন। লঘু পদধ্বনি শুনতে পেয়ে তিনি পেছনে তাকালেন। দেখলেন উঁচুকায় বর্শাধারী দুলোক এগিয়ে আসছে। চেহারা-সুরতে এরা খ্রিস্টান। চোখে-মুখে হিংস্রতা। সালারের দিকে তাকিয়াই ওরা তাকে ঘিরে নিল। উবাইদুল্লাহর নিজ ভুলের উপলব্ধি হলো। আগন্তুকদের কথায় প্রভাবিত হওয়া ঠিক হয়নি।
কি চাও তোমরা? আচমকা প্রশ্ন করেন তিনি।
যা চাই তা পেয়ে গেছি। দুজনের একজনে বলল।
সালারে আলা! তোমার দুদেহরক্ষীকে আমরা শেষ করে দিয়েছি। দেউরীর দরজা থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল। তিনি ভড়কে পেছনে তাকালেন। এ কণ্ঠ সেই আগন্তুকদের যারা তার সাথে প্রতারণা করেছে। ওদের হাতে তলোয়ার। টাটকা রক্ত ঝরে পড়ছে তা থেকে।
তুমি এক্ষণে আমাদের হাতে বন্দী। ভয় নেই। আমরা তোমাকে হত্যা করব না। ফ্রান্স সম্রাটই এ বেলার বিচার করবেন। একজন বলল।
খ্রিস্টানদের হত্যার হিসাব দিতে হবে তোমাকে, আরেকজনে বলল।
আরেকজন অগ্রসর হয়ে বলল, তোমার তলোয়ার আমাদের কাছে সোপর্দ কর।
উবাইদুল্লাহ ঈমানদীপ্ত কণ্ঠে বললেন, জান দেব তবু তলোয়ার সোপর্দ করব না। তোরা ৮ জন, আমি একা, তোদের বর্ণা আমার দেহ ঝাঁঝরা করে রূহ বের করে নিলেই কেবল পারব তলোয়ার কজা করতে।
সাবধানে কথা বলো উবাইদুল্লাহ! আমরা তোমাকে হত্যা করতে চাই না, আমরা তোমাকে জীবন্ত বন্দী করতে চাই। কিন্তু শক্তি পরীক্ষা করলে অহেতুক জীবনটা ঘোয়াবে।
আমি এজন্যে পূজারী প্রস্তুত। জীবিত নয় মৃত উবাইদুল্লাহ-ই ফ্রান্স সম্রাটের প্রাসাদে যাবে।
আমরা ক্রুশ পূজারী। তোমার রাসূল (স)-কে ডাক, পারলে আমাদের হাত থেকে তোমাকে উদ্ধার করুক। আমরা তলোয়ার চাই-দিয়ে দাও।
তলোয়ার আমার রাসূল (স)-কেই দেব। রাসূলের অনুসারীরা দুশমনের হাতে তলোয়ার দেয় না।
এসময় বাইরে অসংখ্যা অশ্বখুরধ্বনি শোনা গেল, যা আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল। জনৈক খ্রিষ্টান বলল, দেখতো? বাইরে কারা এলো?
ওদের একজন বেরিয়ে গেল। পরে ফিরে এসে বললো, একে হত্যা করে বেরোও।
সালার উবাইদুল্লাহ অনুমান করলেন তার সোকজন এসে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরা খোঁজারু বাহিনী। এলাকায় বিচরণ করে পরিস্থিতির প্রতি নয়র বুলাত। সংখ্যায় জনাবিশেক। বাংকারের সামনে এসে তারা ঘোড়র গতিরোধ করল। তাদের-ই পরিচিত দেহরক্ষী বাহিনীর দুসদস্যের লাশ দেখে সন্দেহ হল। তারা আরো দেখল, এরা সেনাপতিরই দেহরক্ষী। তাছাড়া খালি ঘোড়াটি যে সেনাপতির এতে তাদের কোন সন্দেহ ছিল।
খ্রিষ্টানদের কমান্ডার ভেতরে এলো। সকলে তাকাল তার দিকে। উবাইদুল্লাহ তলোয়ার বের করলেন। এবং অতি কাছের এক খ্রিস্টানের গরদান কেটে ফেললেন। সেই সাথে ভীত কমান্ডার সকলকে ভেতরে ডাকলেন। কমান্ডারের নির্দেশ পালন করা হলো। কজন বাইরে দাঁড়িয়ে আগত মুসলিম সেপাইদের প্রতিহত করছে আর কজন বর্শাসহ উবাইদুল্লাহর ওপর আক্রমণ চালাল। যারা বাইরে বেরোল মুসলমানরা তাদের পথ আগলে রাখল। ওরা পলায়নের কোন কোশেশ করেনি- মোকাবেলার জন্যই ওদের বেরোনো। উবাইদুল্লাহ বর্শাধারীদের প্রতিহত করে যাচ্ছিলেন। বর্শাধারীদের বর্শাগুলো খুবই লম্বা বিধায় এগুলো ভেদ করে আক্রমণ করা যাচ্ছিল না। ওদিকে তার অনুসন্ধানী বাহিনীর সদস্যরা ক্রুসেডারদের আগমত ধোলাই দিচ্ছিল।
তলোয়ারের আঘাতে সেনাপতি একটি বর্শা ভেঙ্গে ফেললেন। ইতোমধ্যে তার দুসেপাই ভেতরে এসে পড়ল। এক খ্রিস্টানকে পয়লা আঘাতেই যমালয়ে পাঠাল তারা। উবাইদুল্লাহর হুকুমে তারা জিন্দা একজনকে পাকড়াও করল। তিনি বাইরে এসে দেখলেন ক্রুসেডারদের সকলে মারা পড়েছে, আর তার বাহিনীর মাত্র তিনজন শহীদ। ঈসায়ীরা বড় জোশ-জযবার সাথে এই খণ্ড লড়াই করেছিল।
জীবিত যে লোককে পাকড়াও করা হলো তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এরা কারা, কি উদ্দেশ্যে এই ফাঁদ পেতেছিল? বন্দী সেপাইটি বলল,
জীবনের মায়ায় আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেব ভাবলে বলব, আপনারা ভুল করছেন। স্যালাস আমার নাম। উবাইদুল্লাহকে গ্রেফতার করতেই এই ফাঁদ পাতা। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল, তার পক্ষ থেকে কোন প্রকার আক্রমণ এলে হত্যা করে ফেলার। এতটুকু বলতে পারি, তাঁকে গ্রেফতার করে ফ্রান্স সম্রাট সুইয়ের কাছে নিয়ে যাবার কথা। এর চেয়ে বেশী কিছু বলতে পারব না।