তবুও আমি সতর্ক পদক্ষেপের পক্ষপাতী। আমি যেমন তোমাকে ভয় পাই না, তেমনি পাই না মুসলমানদেরও। বললেন টলুই।
আপনার বাপ-দাদাও সতর্ক পদক্ষেপের পক্ষপাতী ছিলেন যার ফলশ্রুতিতে স্পেনে মুসলিম শাসনের গৌরবময় এক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে গেছে। আপনি দেখছি পূর্বসূরীদের পদাংক অনুসরণ করে ফিরছেন। স্পেনে আমরা যেমন গোলামের জাতিতে পর্যসত ঠিক তেমনি আমাদের ধর্ষও। আপনার হৃদয়ে যদি ঈসা মসীহ এবং কুমারী মরিয়মের ভারাসা ও ইজত থাকত তাহলে আপনি এভাবে যত গুটিয়ে বসে থাকতে পারতেন না। তারপরও কি আপনি বলবেন, আমি আবেগ তাড়ি হয়ে এই সূদূরে ছুটে এসেছি? আমি মহৎ এক উদ্দেশ্যে এসেছি। সে উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত নয়। আপনার মত বিশাল বাহিনী আমার অধীন থাকলে মুসলমানদের স্পেনছাড়া করতে না পারলেও তাদের সুস্থে বসে থাকতে দিতাম না। ওদের লোকালয়ে গুপ্তহত্যা ও গেরিলা হামলা চালাতাম। শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে এলোগেইছএর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।
আমরা তোমার চেতনার কদর করি এলোগেই। কিন্তু তোমার হয়ত জানা নেই যে, আরব মরুচারীদের পরাভূত করা দুঃসাধ্য। সম্রাট লুই বললেন।
তার মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি? এলোগেইছে, কণ্ঠে বিস্ময়।
আমি বলতে চাচ্ছি, মুসলমানরা ধর্মীয় উদ্দীপনা নিয়ে লড়াই করে। আল্লাহর সন্তুষ্টিকয়ে ওরা দুশমনের বিরুদ্ধে লড়ে। ওরা মনে করে, খোদা নাকি ওদের সাথে কানে। এলোগেইছ। তুমি ওদের স্পেন বিজয়ের গোড়ার কথা যদি জেনে না থাক, তাহলে আমার থেকে শুনতে পার। ওরা সংখ্যায় ছিল হাজার সাতেক। স্পেন উপকূলে অবতরণ করেই ওরা ওদের রণতরীগুলোয় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল যাতে কারো মনে পলায়ন করার মানসিকতা জেঁকে না বসে। তুমি হয়ত বাহিনী গড়তে পারবে কিন্তু এই চেতনা পাবে কোথায়? এই চেতনা-ই ওদের স্পেন বিজয়ে সহায়তা করেছিল সেদিন। ওদের ঘোড়া যেখানেই যেত সেখানেই বিজয়ী পতাকা উড্ডীন হত। কোন অভিযানেই ওরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেনি। খুব সম্ভব ফ্রান্স ওদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। ফ্রান্স বিজয় করে ও স্পেনের সীমানা বাড়াতে চাইবে। থামলেন সম্রাট লুই।
আপনি ওদের এই অগ্রযাত্রা রোখার কোন উদ্যোগ নেবেন না? আমি তো ওদের পায়ের তলার যমীনও ছিনিয়ে নিতে পরিকল্পনা সেধেছি। শেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার মত বাহিনীও তৈরী করছি। এলোগেইছ বললেন।
আমাদের মেহমানের কি জানা নেই যে, এ পর্যন্ত কি পরিমাণ খ্রীস্টান মুসলমান হয়েছে? বলে সম্রাট লুই মন্ত্রী কেনেথের দিকে তাকালেন, ওরা পাকা মুসলমান বনে গেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ওরা কান দেবে না। তনুমন দিয়েই ওরা ইসলাম গ্রহণ করেছে।
এলোগেইছের ঠোঁটে পরিধি বাড়ান মুচকি হাসিফুটে উঠল। তিনি রাজ দরবারে উপবিষ্ট জনের প্রতি তাকিয়ে নিলেন। বললেন, জানি সে কথা। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না, ওদের আমি হাত করে নিয়েছি ইতোমধ্যে। বেশক ওরা মুসলমান। মসজিদে নামায পড়ে, রোজাও রাখে। কিন্তু ওদের মন মীনার থেকে কুশ-চেতনা মোছেনি। ওরা পূর্বেকার মত খ্রীস্টান-ই রয়ে গেছে। কারণ, আরব্য মুসলমানরা প্রথম শ্ৰেণীর নাগরিক আর নও মুসলিম খ্রীস্টানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। ওদের ব্যবহার-ই এই শ্রেণী বৈষম্যে বাধ্য করেছে। এটাই আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। ও নও মুসলিমদের ধোঁকা দিয়ে চলেছে। ওরা নামায পড়লেও তলে তলে মুসলিম শেকড় কেটে চলেছে। ওদের একজন জাদরেল নেতা দরকার। দরকার কোন খ্রীষ্ট শামরে মদদ। মদদ দ্বারা উদ্দেশ্য, ফৌজি মদদ।
সম্রাট লুই এলোগেইছের কথায় নিশ্চিত হলেন যে, লোকটা মুসলমানদের গোয়েন্দা নয়। এই উদ্দেশ্য মনে মনে পুষে আসছেন তিনি। এই একটা চিন্তা-ই তাকে ততদিন কুরে কুরে খেয়েছে। কেননা, মুসলিম জাতির অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ না করা গেলে একদিন গোটা ইউরোপে ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে।
এলোগেইছ! সম্রাট লুই বললেন, তুমি নিজকে একাকী ভেবো না। আমি বলেছি, ওদের সাথে সম্মুখ সমরে পেরে ওঠা যাবে না। এর মতলব এই নয় আমি হাতমুখ গুটিয়ে বসে থাকব। গোথ মুর্চের রাজা নে হার্টকে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠিয়েছি। মুসলিম শাসনের প্রোথিত শেকড় আমাকে ভূ-গর্ভে গিয়েই কাটতে হবে। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান এখন শেনের শাসক। গুপ্তচর মারফত জেনেছি তার প্রকৃতি, জেনেছি তার চারিত্রিক দুর্বলতার দিকগুলো। বাস্তবিকই তিনি যুদ্ধংদেহী। লড়াই করা ও কানোত অদ্বিতীয় তিনি। তার হৃদয়ে ধর্মোদ্দীপনা টইটম্বুর। স্পেনের সীমা বৃদ্ধিকল্পে তিনি নানান পরিকল্পনার জাল বুনছেন। জ্ঞান-গরিমায়ও কমতি নেই। তাঁর বাবা আল-হাকাম স্পেনের বেশ ক্ষতি করেছেন। বিলাস ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ হিসেবে তিনি যথেষ্ট দুর্নাম কুড়িয়েছেন। তোষামোদ ও চাটুকারদের জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন রাজকোষ। কিন্তু আবদুর রহমান ভিন্ন ধাতুর। তার বাবা মুসলিম স্পেনের যে ক্ষতি সাধন করেছিলেন আবদুর রহমান তা পুষিয়ে দিতে চাইছেন।
এতদসত্ত্বেও তার চরিত্রের একটা দিক খুবই দুর্বল। সংগীত ও নারীর প্রতি তার রয়েছে অগাধ আকর্ষণ। রণাঙ্গন থেমে বিমুখ করতে ওই দুটো অস্ত্র আমাদের প্রয়োগ করতে হবে। এলোগেইছ যাও! চেতনা ও আবেগ দুটোই পুঁজি করে বেরিয়ে পড়। জানি, তুমি বেছে বেছে এক একটা মুসলমানকে হত্যা করতে চাইছ। ফলে একদিন সম্মুখ সমরে লড়াই। যার পরিণতিতে আমরা চরম মার খাব। কিছু একটা যদি করতেই চাও তাহলে ওদের দুর্বল দিকগুলো আরো দুর্বলতর করে তোল। বললেন সম্রাট লুই।