চলো সে আমাদের অপেক্ষায়! ওকে কোন প্রকার সন্দেহে ফেলা উচিত হবে না তোমাকে আবারও বলছি, আত্মসচেতন থেকো সর্বদা। যিরাবের দৃষ্টিতে সুন্দর থাকবে। রূপ-মাধুর্যে ডুবিয়ে রেখে কার্যোদ্ধারই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা এক সময় যিরাবের কাছে এলো।
তোমার কর্মকাণ্ড শোনা এবং শুনানোর মত দীর্ঘ সময় আমার হাতে নেই। আমার চাহিদা মোতাবেক তুমি কাজ করে যাচ্ছ বলে শুনেছি। আমার প্ল্যান বুঝতে পারায় তোমাকে ধন্যবাদ। এ স্বার্থ কেবল আমার নয়-তোমারও। ক্ষমতা-লোভী নই আমি যে, তোমাকে বলব স্বধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান হয়ে যাও। আমার দৃষ্টিতে ধর্মের কোন মূল্যায়ন নেই। মানবতার মুক্তিকামী আমি। তোমরা দুজন মানুষ। সুলতানা ভুবন মোহিনী আর তুমি উঁচুস্তরের সংগীতজ্ঞ না হলে তোমাদের এই পদমর্যাদা জুটতো কি, দরবারে যা হাসিল করেছো তোমরা। আবদুর রহমান স্পেন শাসন করার যোগ্য বলে তুমি মনে কর কি? শাসন করার যোগ্য সে তো তুমি-ই? যার যার মোগ্যতানুযায়ী প্রাপ্তি বুঝে নাও।
আবদুর রহমান সম্পর্কে আপনি ভুল ধারণা করছেন। যিরাব বলেন, তার যোগ্যতার কথা প্রতিবেশী খ্রিস্ট রাজন্যবর্গ অকপটে স্বীকার করেন। আপনার হয়ত জানা নেই যে, তার বাবা আল-হাকাম যখন আমাকে স্পেনে নিয়ে আসেন তখন প্রশাসনের লাগাম তার মুঠায় ছিল। বেশীর বেশী এতটুকু বলতে পারেন যে, আমি ও সুলতানা তার বুদ্ধিমত্তা ও মোগ্যতা উপেক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছি। নারী ও সংগীতের প্রতি লোকটার টান না থাকলে স্পেনে কোন খ্রিস্টান বিদ্রোহের কথা কল্পনাও করত না। আজো কেউ তাকে আমাদের পথ হতে বিচ্যুত করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে। তবে আমি ও সুলতানা সহজে তা হতে দেব না। গোটা প্রাসাদে আমি মুসলিম চেতনা বিরোধী ইউরোপিয়ান কালচার চালু করে দিয়েছি। যেভাবে ধর্মের প্রতি আপনার কোন আকর্ষণ নেই সেভাবে নেই আমারও।
যিরাবের সত্যিই ধর্মের প্রতি কোন অনুরাগ ছিল না। কিন্তু এলোগেইছের ছিল শতকরা ১০০ ভাগই। যিরাবের মত জ্ঞানী মানুষ ঠাহর করতে পারল না যে, এলোগেইছ তাকে ধোকা দিচ্ছে। আবদুর রহমান নারী ও সংগীতের প্রতি দুর্বল মন্তব্য করে যিরাব নিজেই যে এক নরীর প্রতি দুর্বল তা বুঝতে পারল না। অনুধাবন করতে পারল না, সুলতানা তার বিবেকের ওপর সওয়ার হয়ে বিধর্মীদের স্বার্থোদ্ধার করে যাচ্ছে।
ওই রাতে তারা অনেক কথা বলল। পূর্ব প্রানেরই চর্বিত চর্বণ করা হলো এলোগেইছ সতর্ক লোক। সে ওদের কাছে গুপ্তকথার একবর্ণও উচ্চারণ করল না। ধুরন্ধর আর কাকে বলে।
***
সালার উবাইদুল্লাহ প্যাম্পেলনায় ফ্রান্সীয় ফৌজকে চরম মার দিয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তার বাহিনী ছিল ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন। পথিমধ্যে তিনি একটি ময়দানে খিমা গেড়েছিলেন। স্থানটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণ। এ সময় দু ঘোড়সওয়ার আবির্ভূত হলো। সাধারণ মুসাফিরের মত দেখতে তারা। তারা জানাল, আমরা খ্রিস্টান ছিলাম, ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং সালারে আলার সাথে দেখা করতে চাই। রহস্যময় একটি কথা তাঁর কাছে বিবৃত করতে চাই। তল্লাশি করে এদের কাছে কোন অস্ত্র পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সালারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।
হতে পারে এটা আমাদের ভ্রান্তি বিলাস। আগন্তুকদ্বয়ের একজন বলল, কিন্তু আমরা যা অবলোকন করেছি তা আপনার গোচরে আনা জরুরী মনে করেছি। আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি ইসলামকে মুক্তি ও শান্তির ধর্ম মনে করেই।
দীর্ঘ এই ভূমিকার পর তারা জানাল, আমরা ময়দানে বিচার করছিলাম আচমকা চার/পাঁচজন মহিলাকে একটি বাংকারে প্রবেশ করতে দেখলাম। পোশাক-আষাকে তাদেরকে অত্র এলাকার বলে মনে হলো না। এই বিজন অঞ্চলে তারা একাকী সফর করতে পারে না। আমরা দুজন এদের অনুসরণ করলাম। বাংকারটি পুরানো একটি গীর্জার মধ্যেই ছিল। আমরা দুজনই ওই নারীদের দেখেছি। দেখতে ওরা গ্রাম্য। জিজ্ঞাসা করেছি, তোমরা কে, কোত্থেকে এসেছ? কোথায় যাচ্ছ?
তারা বলল, আমরা মুসলমান, মুসলিম ফৌজের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলছি। আমরা ফৌজের সালারের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। কিন্তু নারী হিসেবে আমরা সাক্ষাৎ করার সাহস পাচ্ছি না। আমাদের কাছে এমন তথ্য আছে, যা সেনাপতিকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না। দেখা না পেলে আমরা এমনিতেই চলে যাবো। ওরা এখানে এসে সব কথা শুনতে পারেন।
উবায়দুল্লার ঠোঁটে রহস্যপূর্ণ হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন– তোমরা কি আমাকে বেকুফ ঠাওরাচ্ছ?
পুরুষ হলে আমরা ধরে আনতাম, কিন্তু নারীর গায়ে হাত দিয়ে আমরা কোন সমস্যার জড়িয়ে যাই-এজন্য ধরে আনেনি। তদুপরি আমাদের সাথে আসতে বলেছিলাম, কিন্তু আমাদের সাথে আসতে রাজী হয়নি ওরা। ওদের দুজন কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। জানিনা, কি সে কথা যা তারা আপনার কাছেই বলতে চায়। আপনি কি নারীদের ভয়ে কুঁচকে গেলেন? না গেলে সে আপনার মর্জি। আমরা পর্যটক। এখান থেকেই আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে।
ওদের কথায় সালার উবাইদুল্লাহ প্রভাবিত হয়ে রওয়ানা করলেন। সঙ্গে স্রেফ দুজন দেহরক্ষী। ওই এলাকায় তিনি তল্লাশি চালিয়ে যে থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি করছিলেন তাতে কেউ তার সাথে প্রতারণা করবে বলে তার মনে হয়নি।