সালার আবদুর রউফের চেহারায় ঝিকিমিকি ও চোখে উদ্যমী আলোর রেখা ফুটে উঠল। এটি তার অধ্যাত্ম নূর যা মুখমণ্ডলে দীপ্ত হয়েছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা আত্মসম্ভ্রম বোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ববান–ক্ষমতা বা গদীর লোভে লোভী নন।
***
এমন ঝিকিমিকি কিছুটা যিরাবের চেহারায়ও যে ছিল না তা কিন্তু নয়। যিরাব যদিও মদ্যপ ছিল, কিন্তু তার মাদকতা সুলতানার জীবনে আসার পর আরো বেড়ে যায়। সুলতানার জায়গীরে সে ইতিপূর্বেও গিয়েছে। মহলে দম আটকে আসছে- মুক্ত বায়ু সেবনের এ অজুহাতে যিরাবসহ সুলতানা কতবার তার জায়গীরে গিয়েছেন এর ইয়ত্তা নেই। আবদুর রহমানের অস্বীকৃতির কোন সৎসাহস ছিল না। প্রথমদিকে তিনি চুপেচাপে যিরাবকে সাথে নিতেন, কিন্তু পরবর্তীতে একাকিত্বের জ্বালা ঘুচানোর অজুহাতে খোলামেলা সাথে নিয়ে যেতেন।
চাঁদনী রাত। কমলকুঞ্জে পুষ্পসৌরভ, দুর্বাঘাস মখমলের সবুজ গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। এর ওপর কপোত-কপোতী উপবিষ্ট। নিথর-নিস্তব্ধ রজনী। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। পিয়ানো যিরাবের সবচে আকর্ষণীয় বাদ্যযন্ত্র। এতে সুর তুলে সে শ্রোতাকে অচিনপুরীতে নিয়ে যেত। এতে সে সুর দিয়ে যে কাউকে অন্য জগতে নিয়ে যাবার যোগ্যতা লাভ করেছিল। সুলতানার তন্ত্রীতে খেলে যায় শিহরণ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সে যেন এর থেকে মুক্তি চাইছে। যিরাব বলে।
তুমি আমার পাশে না থাকলে আমার ব্যক্তিত্ব লোপ পায়। আমি তোমার সত্ত্বায়লীন হয়ে যাই। যিরাব সুলতানার হস্তস্পর্শ করে কাছে টানে। কাছে আসার স্থলে সুলতানা দূরে সরে। যিরাব মৃদু হাসে। বলে, তুমি জান না, কি পরিমাণ তৃষ্ণার্ত আমি। ওভাবে দূরে থেকো না।
খোদা তোমাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন যিরাব। কিন্তু প্রেমরহস্য এখনও তোমার কাছে অজানা। তুমি কি সত্যিই তৃষ্ণার বিস্বাদ পাচ্ছ? সুলতানা বললেন।
বিরহের স্বাদ তুমি নিয়েছ কি কখনও? নাকি এতদসম্পর্কে তোমার কোন এক্সপেরিয়েন্স নেই?
বিরহের তড়পানিতে যে স্বাদ– বিরহে তা নেই। পুরুষের প্রকৃতিতে টোকা মারায় ওস্তাদ সুলতানা বললো, তোমার হয়তো জানা নেই স্পেনরাজ অন্ধ নন কিন্তু আমার প্রেমে তিনি তা-ই। তার প্রেমের বয়স আমার বয়সের চেয়েও বেশী। যেদিন তিনি আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে যান সেদিন আমি হেরেমের নিকৃষ্ট এক কীটে পরিণত হই। আমি চাই না, তুমি আমার দেহের স্বাদ নিয়ে অমন বিরক্ত হও। আমি এক রহস্য। এই রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে তোমার হৃদিক তড়পানিতে ভাটা আসবে। তুমি আমাকে খেল-তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত করলে তোমাকে নিছক রূপের হাটের সওদাগর মনে কবর। আমাকে আমার পূজা করে যেতে দাও।
যিরাবের হাতের বাঁধন ঢিল হয়ে এল। যিরাবের জীবনে সুলতানার এই আলাপ প্রথম নয়। যে তৃষ্ণা তিনি যিরাবের মনে পয়দা করেছেন ঠিক তদ্রূপ পয়দা করে আবদুর রহমানের বেলায়ও। মহলের তিন বাদির মধ্যে স্পেনরাজকে মত্ত রেখে সুলতানা তার যাদুকরী চাল চালিয়েই যাচ্ছেন। আবদুর রহমানের পাশে থেকেও দূরত্ব বজায় রেখেই চলতো এই রহস্যময়ী নারী।
***
সন্নিকটে অশ্বখুড়ধ্বনি শোনা গেলে যিরা বলল, এলোগেইছ এল বলে।
মনে হয় তা-ই। তুমি এখানে বস। আমি তার সাথে দেখা করে আসি। তিনি চলে গেলেন। তাদের ধারণা যথার্থ। আগন্তুক এলোগেইছ-ই। সুলতানা তার ঘোড়ার লাগাম জনৈক নওকরের হাতে তুলে দিলেন। এলোগেইছকে নিয়ে গেলেন, খানিক দূরে। বললেন, যিরা আছে আমার সাথে। আমি একটি মুসিবতে পড়ে গেছি এলোগেইছ! সে কথা তুমিও জানো যে, সে আমার প্রেমে দিওয়ানা। পরিণতিতে আমিও কেমন যেন তার প্রতি ঝুঁকে পড়ছি ক্রমশ। দেখো এলোগেইছ! তোমার কথামত আমি যতই ওর জন্য মরীচিৎকার অভিনয় করছি ততই হন্যে হয়ে সে আমার পিছু নিচ্ছে। কিন্তু এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারছি না যে, ওর প্রতি আমারও দুর্বলতা আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ও নয় বরং আমিই ওর প্রতি প্রেমের পরাগরেণু ছড়াচ্ছি। এক্ষণে আমার জানার ইচ্ছা, কি যাদু আছে ওর মধ্যে যদ্দরুন আবদুর রহমানের মত ধীমান, জ্ঞানী ও চৌকস লোককেও মুরিদ সাব্যস্ত করতে পেরেছে? উপরন্তু দেখছি সে একটি জাতির তাহযীব-তামদুনও সমূলে বদলে ফেলেছে।
এলোগেইছ যেন তেন খ্রিস্টানের নাম নয়। সে যেমন খ্রিস্ট আলেম তেমনি মুসলিমও। সে যদিও সঙ্গীতজ্ঞ নয় তথাপিও জ্ঞান-গরিমা ও বাগ্মীতায় যিরাব থেকে কম নয়। সে খ্রিস্ট সমাজে মুসলিম বিরোধী এমন জীবাণু ছড়ায় যদ্দরুন তারা মুসলিম বিরোধী হয়ে যায়।
প্রেম কোন পাপকর্ম নয় সুলতানা! কিন্তু আত্মসচেতন লোকেরা আপনার অভিষ্ট লক্ষ্য ও ব্যক্তিত্বকে প্রেমের ওপর কোরবান করে না। আমরা তোমাকে সম্রাজ্ঞী বানাচ্ছি, সেই দৃষ্টি নিয়েই তোমাকে দেখে থাকি, কিন্তু অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছুতে তোমাকে নাটক করে যেতে হবে। সেই নাটকের একটা অংকে যিরাবের সাথে নায়িকার ভূমিকায় থাকতে হবে। ওর প্রতি মনের মাধুরী মেশানো টান দেখাতে হলে ওকে আত্মসচেতন হতে দেয়া যাবে না। সর্বদা তোমার রূপ-মাধুর্যে ডুবিয়ে রাখবে। শুনেছি সে আমাদের অনেক কাজ করেছে। সম্প্রতি এমনও লোকদের দেখেছি যারা আরব হয়েও পোশাক আশাকে আমাদের মত।
তুমি বহুত কমই দেখেছ, আমরা ওর চেয়েও সর্বক্ষেত্রে সফলকাম হয়েছি। বললেন সুলতানা