জন্মগত কারিশমা ও অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর তার সংগীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এছাড়া সে বিজ্ঞ ফ্যাশন ডিজাইনার ছিল। সাদা কাপড়ের ওপর নকশা ও ফুল বুননে ওই যুগে সে অদ্বিতীয় হিসেবে আখ্যা পায়। নারীদের এমনও পোশাক সে বানাতে পারত যা তাদেরকে নগ্ন বানানোর নামান্তর। চিত্ত বিনোদনের নামে নিত্য-নতুন প্রোগ্রাম তৈরিতে ওস্তাদ ছিল এই যিরা। যে স্পেনে একদা আরবী তাহযীব-তামাদুন জারী ছিল এই লোক সেখানে সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনল। আরবী কালচার বদলে গেল। যিরাবের রকমারি শৌখিন ফ্যাশন ও আধুনিকতার নিপুণ ছোঁয়াই এর মূলে কাজ করেছিল সেদিন।
আরব থেকে আগত মুসলমানরা বাবরী চুল ও লম্বা দাড়ি রাখতেন। যিরাবের সাংস্কৃতিক বিপ্লব সেই আরবদের বাবরী পাংক-এ এবং পোষাকে ইউরোপিয়ান স্টাইল আনল। তাদের দাড়ি ছোট হতে লাগল। এক সময় শেভ শুরু হলো। দূর আকাশের ওই হাজার সিতারা তার নীরব ভাষায় বলে চলেছে, ক্রুসেডাররা মুসলমানদের স্পেনছাড়া করেনি বরং যিরাবের মত সাংস্কৃতিক কর্মীরাই এ জাতিকে ডুবিয়েছে। স্পেন ট্র্যাজেডি প্রমাণ করেছে, যে জাতিকে তলোয়ার দ্বারা নিশ্চিহ্ন করা যায় না, সাংস্কৃতিক বিপথগামিতাই তাদের নাস্তানাবুদ করতে যথেষ্ট। যিরাবই নারী সুষমাকে পরপুরুষের সামনে সুন্দর আদলে ফুটিয়ে তুলেছিল। খোশবু আতর আবিষ্কার করেছিল।
ধুরন্ধর যিরাবের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুসলিম মননের পরতে পরতে প্রভাব সৃষ্টি করল। সে প্রবাদ পুরুষ বনে গেল। কুদরত তাকে এমন বিস্ময়কর মেধা দান করেছিলেন যদ্দরুন সে নিত্য নতুন ফ্যাশন উদ্ভব ঘটাতে লাগল। তার প্রকৃতিই এমনটা হয়ে গিয়েছিল।
যিরাবের প্রভাব রান্নাঘর থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। স্পেনরাজ পর্যন্ত তার প্রতি অনুরাগী ছিল। যে সব তদবিরকারগণ বাদশাহর দরবারে প্রবেশানুমতি পেত না তারা যিরাবের শরণাপন্ন হতেই মুশকিলে আসান হত। এর ফলে বাদশাহ-বেগম, উজির-নাজির, শাহযাদা-শাহযাদীদের চোখে সে অল্প দিনেই প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আবদুর রহমানের নিঃসঙ্গ মুহূর্ত তাকে ছাড়া চলেই না।
সুলতানার আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে। আবদুর রহমানের দিবানিশির স্বপ্ন ওই কালনাগিনী। তিনি যখন যিরাবের সাথে প্রেম নিবেদন করেন তখন প্রমাণ মেলে যে, সুলতানা যিরাবের– আবদুর রহমানের নয়। এই প্রেমাভিনয়ের পেছনে ইসলামের ঘোরতম দুশমন এলেগেইছের হাত ছিল-যিরাব যা বুঝতে পারেনি। অন্যের ওপর কথার যাদু বিস্তারকারী যিরাব বুঝতে পারল না-সুলতানা তার ওপর যাদু করেছে। এদিকে আবদুর রহমান ঠাহর করতে পারেননি যে, তার সবচে অনুরাগী দাসী তুরুবের রাণী তার নয়-ফিরাবের।
আবদুর রহমানের দরবারে যখন সংগীত আর রূপবতীর এই রূপ-যৌবনের লুকোচুরি চলছিল তখন তার সেনাপতি প্যাম্পোলনায় খ্রিস্টানদের প্রতিরোধ করে যাচ্ছিলেন। তিনি ফ্রান্সের দু কাউন্টকে শোচনীয়ভাবে পরাভূত করলেন যারা অত্র এলাকায় লুটতরাজ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলছিল। এবার তিনি তার বাহিনী নিয়ে কর্ডোভার পথ ধরলেন। তার এই প্রত্যাবর্তন একটানা হয়নি। পথিমধ্যে তিনি স্পর্শকাতর এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। সিংহভাগ এলাকাই পাহাড়ী ও ঘন-ঝোপে ঠাসা। তার কাছে এ মর্মে সংবাদ এসেছিল যে, খ্রিস্টানরা যুৎসই স্থানে গুপ্তঘাঁটি স্থাপন করেছে গেরিলা আক্রমণের জন্য। তার যেখানেই সন্দেহ হয়েছে সেখানেই তল্লাশি চালিয়ে তিনি ঘাঁটিসমূহ ধ্বংস করে দিয়েছেন। এজন্য তার প্রত্যাবর্তন ছিল খুবই ধীরগতির, ঢিমেতালের।
কর্ডোভায় তাঁর প্রত্যাবর্তনের প্রতি আবদুর রহমানের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। এদিকে হাজেব আবদুল করীম এবং অন্য আরেক সালার আবদূর রউফের উবাইদুল্লাহর ব্যাপারে বড় শংকা ছিল। তাঁরা দূত প্রেরণ করে তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন।
সেদিন সালার আবদুর রউফ হাজেবকে বললেন, আমার শংকা হয় আবদুর রহমান এই সাম্রাজ্যকে রসাতলে দেয় কিনা। এর কি কোন প্রতিকার নেই?
আমরা আবদুর রহমানকে হত্যা করতে পারি। যিরাব ও সুলতানাকেও পরলোকের পথ দেখাতে পারি-কিন্তু এতে লাভ? আবদুর রহমান খান্দানেরই কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হবে। পরে একটা রেওয়াজ হয়ে যাবে যে, হত্যা কর, ক্ষমতা দখল কর। এতে খেলাফত দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। আমরা সাধ্যমত আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাই-এই ভালো। বললেন-হাজেব।
স্পেন গভর্নরকে আমি একটা কথা বলতে চাই। দেশ শাসন কর-কিন্তু ইসলামের নাম মুখে এনো না। ধর্মের নামে সে আমাদের সাথে প্রতারণা করছে। নয়নাভিরাম মসজিদ নির্মাণ করছে। কথায় কথায় কোরআনের রেফারেন্স টানছে। এটা কি অপরাধ নয়?
আমার যা ধারণা, স্পেন অবক্ষয় নয় পতনের চোরাবালিতে আছড়ে পড়তে যাচ্ছে। শাসকবর্গ সংগীত, নারী ও চাটুকারদের পাল্লায় পড়লে দেশের ভিত্তিমূলে ঘুণ ধরা শুরু করে। শত্রুপক্ষ তাদের তলোয়ারে শান দিচ্ছে আর আমাদের ননীর পুতুল শাসকশ্রেণী ওদের দিকে মিত্রতার হাত বাড়াচ্ছে। কেননা ওদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করলেই ক্ষমতা পাকাঁপোক্ত করা সম্ভব। আবদুর রউফ! তুমি তোমার দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়ে যাও-অনাগত ভবিষ্যৎ তোমাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। হতে পারে তোমার কর্মকাণ্ড তাদের জেহাদী জীবনে প্রাণসঞ্চার করবে। পক্ষান্তরে তুমি যিরাবের প্রদর্শিত অপসংস্কৃতির কোলে আশ্রয় নিলে জাতির ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করবে। কালের গতিপথ যেভাবে বদলাচ্ছে তাতে আমার ভয় হয়, বিশ্ব একদিন না আবার ইসলামকে নগণ্য একটি মতবাদ ও কৌলীন্য প্রিয় জাতির ভ্রান্তি বিলাস মনে করে বসে। সেই প্রদীপে আমাদের তেল সঞ্চার করতে হবে, শহীদী খুনের দ্বারা যাকে প্রজ্বলিত করেছিলাম আমরা। কুফরী শক্তি ফুঁসে উঠছে, এরপরও হতে পারে আমাদের ভাগ্য প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলবে। আগামীতে হয়ত এমনও বংশধর আসবে যারা ওই নিভু প্রদীপকে রাসূলে আরাবীর যুগের মত প্রদীপ্ত প্রত্যুজ্জ্বল করবে।