মুসলিম কয়েদীরা এই কেল্লায়ই ছিল। তাদের পায়ে ডাবেড়ী। রাতে ওই বেড়ীর সাথে শেকল পেঁচানো হত। চতুষ্পদ জন্তুর মত তাদেরকে খোয়াড়ে রাখা হত। এদের সকলকে মুক্তি দেয়া হলো।
এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ কেল্লা অবরোধ করা হলো।
উবাইদুল্লাহ যখন ওখান থেকে ফিরে আসেন তখন ওখানে খ্রিস্টান লাশের পাহাড় আর কেল্লায় ধূম্রকুণ্ডলী ঘুরপাক খাচ্ছিল।
১.২ প্রতিরোধ
স্পেনভূমি বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের আখড়ায় রূপ নিতে লাগল। এক শাসকের পর আরেক শাসক স্থলাভিষিক্ত হত। খেলাফতের গদীতে একের পর এক খলিফা আসীন হতে থাকল। বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র কমা তো দূরে থাক আরো বাড়তে লাগল। স্পেন শাসক যিনি কেন্দ্রীয় খেলাফতের গভর্নর ছিলেন নিজকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করলেন। আপনার দায়িত্ব সম্পর্কে বিলকুল উদাসীনতার পরিচয় দিলেন। তারা ইসলামের মহান শিক্ষা ভুলে গেলেন। ভুলে গেলেন ঔসব শহীদানের রক্তস্নাত কাহিনী যাদের বুকের তাজা খুনে স্পেনের সীমানা বাড়ছিল। এসব দুর্নীতিবাজ শাসকের মাথায় ক্ষমতায় নেশা চেপে বসে। রাজত্ব ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার ওপর আলোচনার স্থলে এদের প্রাসাদ চাটুকারিতা ও তোষামোদী চর্চা হতে থাকে।
বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের ভিত্তিমূলে ছিল খ্রিস্টান জাতি আর এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল স্পেনের প্রতিবেশী রাজন্যবর্গ। আমরা ওদের সমালোচনায় কলম ধরতে চাই না। ধরব কি করে-ওরা তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিল, ইসলাম ও মুসলমানদের ইউরোপ থেকে নিশ্চিহ্ন করেই আমরা দম নেব। ওরা একে ধর্মীয় যুদ্ধ সাব্যস্ত করেছিল।
স্পেনের মুসলিম শাসকদের প্রথম ও একমাত্র লক্ষ্য থাকা উচিত ছিল, ইসলাম ও মুসলমানদের জানমাল রক্ষার্থে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কিন্তু তারা এর স্থলে নিজেদের গদীরক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল সেদিন পুরোদস্তুর। পরিণতিতে এক শাসক মারা গেলে তার স্থলাভিষিক হিসেবে বেশ কজন দাবীদার দাঁড়িয়ে যেত। গদীতে বসতে পারত। একজন, কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে তার জ্ঞাতী ভাই ভাইয়ের দুশমনে পর্যবসিত হত এবং তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হত। দুশমন ওই সুযোগে সীমান্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ আর সীমান্তে যখন শত্রুর আনাগোনা তখন প্রাসাদে অবস্থানরত চাটুকাররা রিপোর্ট দিত, দেশ পুরা শান্ত। কোথাও কোন কোন্দল নেই। এসব জ্ঞান-পাপীরা স্বজাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে দিত।
মুসলিম ইতিহাসে চাটুকারিতা তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি, কিন্তু স্পেনে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে প্রতিযুগেই। স্পেন প্রাসাদের চাটুকাররা ছিল খুবই অভিজ্ঞ ও চৌকস। এরা উপদেষ্টা ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিযুক্ত ছিল। ওর যাদুকরি ভাষণে গভর্নরকে কুপোকাত করত। ওদের অন্তরে কোন ন্যায়নিষ্ঠা ছিল না, ছিল না চিন্তায় গভীরতা। জাতির দরদে, ধর্মের দরদে ওদের চিন্তার ললাটে ভাঁজ পড়ত না। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকাও ছিল না। স্পেনে এমন কর্মকাণ্ড হয়ে আসছিল এবং ওইভাবে হয়ে যাচ্ছিল। ইতিহাস থেকে বিমুখ জাতি আমরা। আমাদের পদস্খলন ও নির্বুদ্ধিতাকে চাটুকারদের জ্ঞানের আলোকে চালিয়ে দেয়ার জাতি আমরা। আগামী বংশধরেরা শাসকবর্গের ওপর বিরাগভাজন হয়-এমন ইতিহাস লিখতে আমরা হীনমন্যতার পরিচয় দিয়ে নেহাৎ জুলুম করেছি। স্পেনের ইতিহাস লিখতে হচ্ছে ল্যাটিন কিংবা অমুসলিম ইউরোপিয়ানদের একপেশে ইতিহাসের ওপর ভর করে। এসব ইতিহাসবেত্তা যেখানে গ্রানাডা ট্রাজেডির কথা লিখতে গিয়ে খ্রিস্টানদের বিরোচিত কাহিনী উল্লেখ করেছে সেখানে অন্ধকার ইউরোপের রন্ধ্রেরন্ধ্রে ইসলামের আলো বিকিরণকারী মুসলিম সিংহপুরুষদের কথাও না এনে পারেনি।
স্পেন থেকে ইসলাম সেদিনই বিদায় নিতে শুরু করেছিল যেদিন কেন্দ্রীয় খলীফার নিযুক্ত গভর্নর নিজকে বাদশাহ খেতাব দেয়া শুরু করল এবং চাটুকার কর্তৃক দেশ চালাতে লাগল। কিন্তু তদানীন্তন মুসলিম ফৌজে এমনও কিছু মর্দে মুজাহিদ ছিলেন যারা শাসনবর্গের বিলাসিতা ও হেরেমে নারী সমাবেশ দেখে বিরাগভাজন হয়ে নিজেরা দেশ ও জাতির জন্য জান কোরবান দিয়েছিলেন। তুলে ধরেছিলেন খোদার দ্বীনকে সবার ওপরে।
দ্বিতীয় আবদুর রহমানের যুগে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কুটিল জাল বিস্তার লাভ করছিল। ক্রমশঃ বেড়ে চলছিল এর সিলসিলা। ষড়যন্ত্রের এই বীজ প্রথমদিকের শাসকবর্গের যুগেও ছিল। যেহেতু তারা এর মূলোৎপাটন করেননি, সেহেতু পরবর্তীতে এর শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়।
আবদুর রহমান সবচেয়ে বিষধর যে সাপটিকে তার দরবারে দুধকলা দিয়ে পুষছিলেন যিরাব তম্মধ্যে অন্যতম। অনেক ঐতিহাসিক যিরাবকে বড় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ কয়েছেন। তারা তাকে পাক্কা মুসলমান ও চৌকস বলে মত ব্যক্ত করেছেন। করেছেন। তাকে দেশ প্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত।
সে জ্ঞানী ও চৌকস ছিল বটে তবে তার সবখানিই ব্যয়িত হয়েছে চাটুকারিতায়। ইতিহাসবেত্তারা লিখেছেন, লোকটা সজ্ঞানে ও পাণ্ডিত্যে কর্ডোভার দরবার মাত করে দিত। একদিকে যেমন সংগীতজ্ঞ অন্যদিকে তেমন কূটনীতিবিদও। আবদুর রহমান তার খোদাপ্রদত্ত মেধা ও কর্মকুশলতায় এতই হতবাক হন যে, তাকে শেষ পর্যন্ত প্রাইভেট সেক্রেটারী হিসেবে নিয়োগ দেন। এছাড়া বাগিতা ও তর্কে তার জুড়ি ছিল না।