রাতের বেলায় সালার উবাইদুল্লাহ তার ফৌজ ও সহকারী কমান্ডারদের জাগ্রত করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের দেশে বিদ্রোহের ধূম্রগিরি উদগীরণ হতে যাচ্ছে। এ থেকে আমাদের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে দুশমন সীমান্তে হামলা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।
আমাদেরকে একটি প্রাবনে ভাসিয়ে নিতে দুশমন ফুঁসে উঠছে। আমাদের বাহিনীকে কমান্ডারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল থাকতে হবে। লড়তে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু ও দুস্তর পারাবারে। জীবন দিতে অকুষ্ঠ চিত্ত থাকতে হবে। আল্লাহর সৈনিক অন্যান্য সৈনিক থেকে পৃথক। মহান এক উদ্দেশ্যে আমাদের লড়াই। কোন ব্যক্তি বিশেষ বা খান্দান বিশেষের ক্ষমতার আসন পাকাঁপোক্ত করার জন্য আমরা লড়াই করি না। আল্লাহর আইন মানব-জীবনে প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যেই আমাদের লড়াই। কুফর খতম না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়া ফরয-আমাদের লড়াই কোরআনের এ আয়াতকে সামনে রেখেই।
আমাদের সেপাইদের তারিক বিন যিয়াদের ঐতিহ্য মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, অল্প কজন সৈন্য নিয়ে তারা এদেশে এসেছিলেন। সেই জানবাষ শহীদান আমাদের পবিত্র আমানত। স্পেন উপকূলে নেমেই তারা রণতরীগুলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। সেই চেতনা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
যে কথা আমি বলতে চাচ্ছি, তা তোমাদের সিপাইদের বলো চাই না বলল, তোমরা ধ্যান-খেয়ালের সাথে শুনে নাও-খলীফার পক্ষ থেকে যিনি আমীর নিযুক্ত হয়েছেন সম্প্রতি তাকে বাদশাহ খেতাবে ডাকা শুরু হয়েছে। এটা অনৈসলামিক পন্থা। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় কোন বাদশাহ হয় না, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের ওপর এমন বাদশাহ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যে নামকাওয়াস্তে মুসলমান আর তার কর্মকাণ্ড সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বিরোধী। তার হেরেম আবাদ হচ্ছে গায়ক ও খেমটা নর্তকীদের দ্বারা।
আমাদের বর্তমান আমীরের অবস্থা এমন-ই। তোমাদের পুঞ্জীভূত অভিযোগ পুঁজি করেই বলছি, আমীর সাহেব কোনদিন তোমাদের সাথে দেখা করেননি। নিজ চোখে কোনদিন দেখেননি তোমাদের হাল-হকিকত। তোমাদের অনেকেরই জানা আমাদের বাদশাহ রাগ-রাগিনীতে আসক্ত। সুতরাং এক্ষণে ময়দানে লড়ে লাভ কি।
এমন খেয়ালের কেউ থেকে থাকলে বাহিনী থেকে বেরিয়ে যাও। এ যমীন খোদা তাআলার- তোমরা এর রক্ষক। যার যার কবরে সে যাবে। বাদশাহ তোমাদের কবরে আর তোমরা তাঁর কবরে যাবে না। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, যে দেশে কোরআনের শাসন কায়েম হয় সে দেশ কোন ব্যক্তি বা বংশের জায়গীর হতে পারে না। আমরা সবে এ দেশের মালিক, সুতরাং এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের। বাদশাহর দরবারে নয় আমাদের জবাবদিহি করতে হবে প্রভু পরওয়ারদেগারের দরবারে। এই মহান উদ্দেশ্যে সামনে নিয়েই মুসলমানরা লড়ে থাকে। জয়-পরাজয়ের তোয়াক্কা নেই তাদের।
এভাবে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে উবাইদুল্লাহ উপ-সেনাপতিদের রক্ত গরম করে দিলেন। সকাল বেলা সমস্ত উপ-সেনাধ্যক্ষ মার্চ করলেন।
***
সৈন্যবাহিনীর অগ্রযাত্রা ছিল খুবই তেজোদীপ্ত। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে এরা শহরের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। আবদুর রহমান ন্দ্রিা থেকে গাত্রোখান করে পি এ-র মাধ্যমে সেনাপতিকে খবর দিয়ে বললেন, আমি বাহিনীকে বিদায় জানাতে চাই।
ফৌজ এ মুহূর্তে শহরের চৌহদ্দী থেকে অনেক দূরে চলে গেছে আমীরে মোহতারাম! হাজে আপনার অপেক্ষায় আছেন। পি এ বললেন।
তাকে ভেতরে ডেকে পাঠাও। হাজেব এলে তিনি বললেন, উবাইদুল্লাহ খানিক অপেক্ষা করতে পারত না?
না, আমীরে মোহতারাম? দুশমন এ খেয়াল করে না যে, তাদের প্রতিপক্ষ বাদশাহর বিদায়ী সালাম নিয়ে এসেছে কি-না। বিদায়ী সালামের সময় নেই আমীরে স্পেন। অবধারিত দায়িত্বের হাতছানি এমনই হয়। হাজেব বললেন।
আবদুর রহমানের মনে চাপা ক্ষোভ থাকলেও তা প্রকাশ করার সাহস পান না। হাজেব তাকে শুনিয়ে যান খ্রীস্টানদের কচুকাটা করার প্ল্যান একের পর এক।
সীমান্তের প্যাম্পোলোনা চৌকি।
দুফ্রান্সীয় কাউন্ট এখানে কিছুদিন পূর্বে হামলা করেছে। বেশ কিছু মুসলমানদের তারা বন্দী করে নিয়ে গেছে। তাদের সাথে এরা পাশবিক ব্যবহার করেছে।
কদিনের ব্যবধানে সালার উবাইদুল্লাহ এখানে এসে উপনীত হন। তিনি এখানকার অধিবাসীদের মাধ্যমে এখানকার অবস্থাদি পর্যবেক্ষণ করেন। জানতে পারেন, খ্রীস্টানরা সীমান্তে দুর্গ স্থাপন করেছে। এই কেল্লাপ্রাচীর টপকানো চাট্টিখানি কথাতো নয়। উবাইদুল্লাহ স্পেন পাড়ি দেয়ার অনুমতি আবদুর রহমান থেকে নেননি। নেয়ার প্রয়োজনও মনে করেননি। প্রয়োজনে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করবেন-এক্ষণের সিদ্ধান্তে তার কতকটা এমন-ই।
গভীর রাত।
সীমান্তবর্তী কিছু গাইডের মাধ্যমে তিনি স্পেনসীমানার বাইরে পা রাখেন। গাইডরা তাকে বড় কেল্লাটি দেখান। তাদের চলার শক্তি দ্রুত। আঁধার রাতে তারা কেল্লা ঘেরাও করেন। এর পরপরই কামান থেকে পাথর ছোঁড়া শুরু করেন সাথে সাথে নিক্ষেপ করেন অগ্নিগোলা। কামানের পাথর আর অগ্নিবান ওইযুগে শক্রমনে বিভীষিকা সৃষ্টি করত।
খ্রীস্টানরা কেল্লাপ্রাচীর থেকে তীর নিক্ষেপ শুরু করে কিন্তু ওদিকে উবাইদুল্লাহ ও তার বাহিনীর মধ্যে চরম উত্তেজনা। তাঁদের কমান্ডার তেঁতে আগুন। অনেক ফৌজ তীর মারতে কেল্লা প্রাচীরে পৌঁছে যায়। তারা কুঠার দ্বারা কেল্লাঘার ভাঙ্গতে শুরু করে এক সময় দরজা ভেঙ্গে ফেলে। তুমুল রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়। বানের পানির মত মুসলিম ফৌজ কেল্লাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এদের অনবরত বর্শাঘাতে বিপক্ষ বাহিনী জাহান্নামে পৌঁছতে থাকে। লাশের পাহাড় হয়ে যায়। এর পরের লড়াই উবাইদুল্লাহ বাহিনীর খ্রস্টানদের লাশে পাহাড় রচনার লড়াই।