উবায়দুল্লাহ! কাঁচা ঘুমভাঙ্গা বাঘের মত গর্জে ওঠেন আবদুর রহমান, কি হলো তোমাদের? আজ এ কি বলছ তুমি?
তখনও তার চোখ অর্ধ নিমিলিত। এবার তা পুরো খুলে যায়। যিরাবের সঙ্গীত যায় থেমে। সুলতানা দূরে দাঁতে দাঁত পেষেণ। আবদুর রহমানের চোখ রক্ত জবার মত লাল। এ লাল রাগ-গোস্বার নয়। এই রক্তিমাভা সর্বপ্রথম দেখছে যিরাব ও সুলতানা। এঁরা অবাক, এ আবার কোন আবদুর রহমান। এ কি কোন ঘুমন্ত ব্যাঘ্রের ন্দ্রিাভঙ্গ, না কি কোন লৌহ মানবের গাত্রোত্থান? তিনি বললেন, তোমরা কি বসবে না? আগন্তুকম্বয়কে বলে তিনি যিরাব ও সুলতানাকে বললেন, তোমরা ওপাশের কামরায় যাও। মনে হয় জরুরী কোন কথা আছে। নইলে এরা এভাবে বিনা অনুমতিতে আসার মত ব্যক্তি নয়। তার কণ্ঠে এক ধরনের ওজর ও মিনতি।
যিরাব ও সুলতানা চলে গেলে উবায়দুল্লাহ ও হাজেব বসে পড়েন। আবদুর রহমান যেভাবে যিরাব ও সুলতানার কাছে মিনতি করলেন তাতে এরা ব্ৰিতিবোধ করে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তারা ফিস ফিস করে বলেন, আজ এর একটা বিহিত বিধান করেই ছাড়বেন। আবদুর রহমান বললেন, বলল! কি বলতে এসেছ?
খলীফা আপনাকে স্পেনের আমীর নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু দরবারী চাটুকাররা আপনাকে স্পেন সম্রাট বলতে শুরু করেছে, আর আপনিও পুরোদস্তুর সম্রাট সেজে বসে আছেন। উবায়দুল্লাহ বললেন।
কি বলতে চাও উবায়েদ! আবদুর রহমানের কন্ঠে শাহী দাপট, তুমি নিজকে সর্বদা রণাঙ্গনের অধীন সেনার মত মনে কর। তোমার কল্পনাও কেবল ক্যান্টনমেন্টসুলভ। যা বলতে এসেছ তা সহজে বল!
না! আমি সহজে বলতে পারছি না। যেদিন আমার লড়াই খতম হয়ে যাবে সেদিন আপনার সিংহাসনের তলার মাটিটুকুও সরে যাবে এবং স্পেনভূমি হতে ইসলামী পতাকা ও আযানের সুরলহরী স্তব্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের তরে। সেনাপতি কখনও দরবারী হয় না। হয় না ক্ষমতালোভী। তার অবস্থান রণাঙ্গনে। অবস্থান কুফর ও বাতিলের বিরুদ্ধে। আপনিও একজন সেনাপতি। রণসিংহ। কিন্তু আফসোস! সেই সিংহশাবককে আজ খোঁচা মেরে জাগাতে হল। সংগীত ও নারী সুষমা লাভের উম্মাদনায় আপনি তলোয়ার। সিংহাসনের নীচে ছুঁড়ে মেরেছেন। আপনার প্রজ্ঞা আছে, মেধা আছে কিন্তু এক উদ্ধত নারী আপনার ওপর আছর করেছে যে আপনাকে জান্নাতী পরিবেশ দান করেছে, যদিও সেটা নিরেট জাহান্নাম।
সমস্যা হচ্ছে, যে জাহান্নামের দিকে উবাইদুল্লাহ ইশারা করছেন ওতে কেবল বাদশাহ একাকী নয় নিপতিত হবে গোটা জাতিই। বাদশাহর ভুলে গোটা জাতি এর ইন্ধন হবে। বাদশাহর অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করে গোটা কওম। দুশমন সম্পর্কে উদাসীন বাদশাহর প্রজাদের ললাটে বিজাতির গোলামী ছাড়া আর কিইবা লেখা থাকতে পারে। হাজেব বললেন।
দেমাগ থেকে ক্ষমতার নেশা ঝেড়ে ফেলুন আমীরে মুহতারাম! আজ বিজাতি অভ্যুত্থানের নীলনকশা তৈরী করছে, কাল মুসলিম ফৌজই আপনার টুটি টিপে ধরতে আসবে। সেনাপতি বললেন।
বিদ্রোহ! অভ্যুত্থান! কেমন বিদ্রোহ। কোন ফৌজ অভ্যুত্থান করবে? আমার জানা নেই। খোদার দিকে চেয়ে খুলে বল। আবদুর রহমান চমকে ওঠেন।
আপনি এজন্য জানেন না যে, দরবারী চাটুকাররা আপনার চোখ-কান বন্ধ করে দিয়েছে। আপনার নিকটতম তোষামোদকারী বেসরকারী উপদেষ্টারা যেটা বলে দেবেন কেবল সেটাই আপনি শুনবেন। এক নর্তকী আর সুরেলা গায়ক আপনার ভেতরকার সিংহপুরুষকে হত্যা করে ফেলেছে। এদেশ স্বাধীনচেতা মর্দে মুজাহিদদের। আপনি তাদের আমীর নন-আমীর জনতার, হাজেব বললেন।
না হাজেব! সুলতানা আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না। যিরাব আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না।
কে ধোঁকা দিল-আর কে দিল না, কে নেমকহারাম আর কে নেমক হালাল–তাও বলতে আসিনি আমরা। এর প্রতি আমাদের কোন আকর্ষণই নেই। আমাদের ক্ষোভ সেসব বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে যারা স্পেন হতে ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিতে চায়। খুব চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন আমীরে মুহতারাম।
উবাইদুল্লাহ ও হাজেব গুপ্তচরদের ডেকে পাঠালেন। আমীরের সম্মুখে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে নির্দেশ দিলেন। তারা বিস্তারিতভাবে রিপোর্ট পেশ করলেন। হাজেব ও উবায়দুল্লাহও এতে কিছু প্রবৃদ্ধি ঘটালেন।
***
আবদুর রহমানের ভেতরের সিংহপুরুষটা সজাগ হয়ে ওঠল।
ওদিকে ওপাশের কামরায় যিরাব ও সুলতানা আক্ষেপে উরু চাপড়াচ্ছিল। সুলতানা কক্ষের শার্সিতে আড়ি পেতে এতক্ষণের আলাপ শুনেছেন। তিনি বললেন,
দুরাচাররা বাদশাহর ভেতরটা জাগিয়ে তুলেছে। তিনি একবারের জন্যও ময়দানে নামলে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবেন। আমরা সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হব। এলোগেইছ বলেছে, বিদ্রোহীরা প্রস্তুত। ওদিকে ফ্রান্স সম্রাট লুই আর বার্সিলোনা ও গোথের বাহিনীও প্রস্তুত। কিন্তু এ তথ্য এরা পেল কি করে? এলোগেইছকে জানিয়ে দেয়া দরকার যে, মুসলিম টিকটিকিরা তোমার প্রস্তুতি জেনে ফেলেছে। জেনে ফেলেছেন আবদুর রহমানও। এদুলোককে পাক্কা টিকটিকি মনে হচ্ছে। যিরাব বললেন।
হা! এরা টিকটিকিই বটে। ওদের খতম করা জরুরী।
যিরাব খুবই চৌকস লোক। তিনি বললেন হত্যা করলে কোন লাভ হবে না। তাদের স্থানে আরো দুজন এসে যাবে। তার চেয়ে টোপ ফেলে ওদেরকে আমাদের দলভুক্ত করতে পারি। ওরা সরকারী গোয়েন্দার ছদ্মাবরণে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কাজ করবে এলোগেইছের হয়ে। এরা সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রীকেও ধোঁকা দিতে সক্ষম।