সুলতানা নারীসুলভ প্রতারণার মাধ্যমে যিরাবকে আবদুর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুললো।
***
সময় বসে থাকে না নিশুপ। সময় এগিয়ে চলে আপন গতিপথে। এক রাতে আবদুর রহমানের উজীরে আলা হাজেব আবদুল করীম দুলোক সহকারে সিপাহসালার ওবাইদুল্লাহর বাসভবনে এলেন।
উবায়েদ। তিনি সিপাহসালারকে বললেন, এ দুজনকে চেনো?
হা! কেন নয়। ওবায়দুল্লাহ জবাব দেন, আমাদের গুপ্তচর বৃত্তিতে ওরা ওস্তাদ।
শুনুন। এরা কি খবর দিচ্ছে।
সালারে মুহতারাম। তন্মধ্যে একজনে বললো, কর্ডোভা সীমান্তে, টলেডো ও মালাকায় খ্রিস্টানরা সশস্ত্র হচ্ছে। অভ্যুত্থানের জন্য তৈরী হচ্ছে। ওরা অতি সংগোপনে নও মুসলিমদের ওদের দলে ভেড়াচ্ছে। গলায় গলায় ভাব ওদের। কি অদ্ভুত ব্যাপার! আমাদের সাথে একসাথে যারা নামায পড়ে তারাই আমাদের বিরুদ্ধে দল ভারী করে চলেছে। খুব শীঘ্র ওরা আমাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। দলভারী মুসলিম সৈন্য ওদের মোকাবেলায় টিকবে না বলে ওদের বিশ্বাস। মরনের অঙ্গীকার নিয়েছে ওরা।
গুপ্তচররা আরো জানাল, ফ্রান্স সম্রাট লুই ওদের তলে তলে মদদ যোগাচ্ছেন। ওদিকে গোথমার্চের সম্রাট ব্রেনহার্ট স্পেন ভূমি যতটুকু সম্ভব দখল করবে। এই গুপ্তচরদ্বয় নও মুসলিমের ছদ্মবেশে এদের সাথে কথা বলেছে। তারা বলেছেন, এলোগেইছ নামীয় জনৈক খ্রীস্টান বক্তৃতা ও গোপন পরিকল্পনার মাধ্যমে খ্রীস্টানদের রক্ত গরম করে বেড়াচ্ছে। বিদ্রোহীদের সে-ই শিরোমণি। বিদ্রোহাগ্নি আরো কিছুস্থানে দানা বেঁধে উঠছিল। উজিরে আলা হাজে আবদুল করিমও ইতিপূর্বে এই বিদ্রোহ প্রস্তুতির খবর আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি বারদুয়েক আব্দুর রহমানকে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারীও দিয়েছিলেন, কিন্তু আবদুর রহমান এতে কান দেননি।
উবায়েদ ভাই। হাজেব সিপাহসালারকে বললেন, আমাদের প্রতি এভাবে বেপরোয়াভাব দেখানো হলে কি ভূমিকা থাকবে আমাদের? আমরা তো তার মত উদাসীন থাকতে পারি না।
না। সালার উবায়দুল্লাহ বললেন, স্পেন আবদুর রহমানের নয়। এ সেই স্পেন যা এক সিংহের জাতি জয় করেছিল। ওরা এদেশ জয় করে পুনরায় ফিরে যায়নি। আফসোসের বিষয়, সাধের সেই স্পেন আজ গোষ্ঠীবিশেষের উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে রূপান্তরিত। দেশ ও জাতির সাথে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। ওদের সম্পর্ক গদির সাথে, বিলাসিতার সাথে। আজ স্পেনের বড় দুশমন ওই ক্ষমতাসীনরা যারা চাটুকারদের ইশারায় ক্ষমতা চালাচ্ছে। এই ভূ-খণ্ডকে কুফরের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। বহিঃশত্রুর যড়যন্ত্র ও বিদ্রোহীদের মদদ দেয়ার পর আমার কানেও এসেছে। সেটার সত্যায়ন করলে তুমি। তোমরা যদি আমার পরামর্শমত কাজ কর তাহলে আমীর আবদুর রহমানের কাছে চলো।
আমার পরামর্শও কতকটা এমন। কিন্তু এক্ষণে সে স্পেনসুন্দরী সুলতানা আর গায়ক যিরাবের কজায়। এই কজা জ্বিনে ধরা রোগীর মত। এ এমন এক প্রাচীর যা টপকাতে পারব না আমরা।
হাজের বললেন, চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা কোথায়? বললে এখনই যেতে চাই। ওবাইদুল্লাহ বললেন।
হাজেব ও উবায়দুল্লাহ উভয় গুপ্তচরসহ প্রাসাদ অভিমুখে চললেন।
উজিরে আলা ও সিপাহসালার জরুরী কথা নিয়ে আমীরের সাথে দেখা করতে চান- এ মর্মে আবদুর রহমানের কাছে খবর এলে সুলতানা বেরিয়ে এলেন। পরনে তার নগ্নপোষা। তার আকর্ষণীয় চাঁদমাখা বদনে বিরক্তির ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি এদের বললেন,
আপনারা কি দিনের বেলায় দেখা করতে পারেন না? এইমাত্র তিনি যিরাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এ সময় স্পেনরাজ কারো সাথে দেখা করবেন না।
কিন্তু আমরা যে তার সাথে দেখা করেই ফিরে যেতে চাই। হুকুম আমরা তার থেকে চাই-তোমার থেকে নয় সুন্দরী। তাঁকে গিয়ে বললো, আমরা দেখা না করে ফিরব না। উবায়দুল্লাহ বললেন।
আর আমি আপনাদেরকে তার সাথে দেখা করতে দেব না। সুলতানার কণ্ঠে ক্ষোভ ও দৃঢ়তা।
হাজে আবদুল করীম উবায়দুল্লাহকে বললেন, এরপরও কি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে চাও?
আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব না। আবার খালি হাতেও ফিরব না– ভেতরে যাব। হেবেমের এক নারী রাণীর দাপট নিয়ে চলছে। তার বিরক্তি ও দাপটে আমার কিছুই যায় আসে না। উবায়েদ বললেন।
স্পেনরাজ অন্দর মহলে যিরাবের সুর মূর্ঘনায় ডুবেছিলেন। সেই সুর জগত থেকে ভেসে এলো, সুলতানা! তুমি কৈ! ওদেরকে কাল আসতে বল। উবায়দুল্লাহ আবদুর রহমানের কামরায় পৌঁছে যান। হাজেব করেন তাঁর অনুসরণ। পেছনে পেছনে সুলতানা। আবদুর রহমান অর্থ নিমিলিত চোখে সকলের প্রতি দৃষ্টি বুলান।
এদের কি শাহী রেওয়াজ মনে নেই? চাপা ক্ষোভ নিয়ে বাঘিনীর মত গর্জে ওঠে সুলতানা।
কোন জরুরী কথা হবে হয়তবা সুলতানা। সামান্যতেই ক্ষেপে যেও না। এসো আমার পাশে এখানটায় বসো। এরপর তিনি আগন্তুকদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, এমন কি কিয়ামত ঘটে গেছে যে, তোমরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে না? আর যেখানে আমি বললাম, এখন দেখা হবে না, সেখানে তোমরা কোন্ সাহসে অন্দরে প্রবেশ করলে? তোমরা কি তোমাদের পদমর্যাদার কথা ভুলে গেছ? প্রশ্ন, বিস্ময় ও ক্ষোভযুক্ত কণ্ঠে বলেন আবদুর রহমান।
হ্যাঁ! আমীরে স্পেন! আমরা পদমর্যাদার কথা ভুলে গেছি। এই ভূ-খণ্ডের বিজেতা কোন পদমর্যাদার খাতিরে এখানে আসেনি। ওই শহীদান কি বদলা পেয়েছিল যারা এদেশে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টিতে এখানে এসেছিল? অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই পূতঃ পবিত্র যমীনের রাজপ্রাসাদে জনৈকা নগ্ন নর্তকী প্রধানমন্ত্রী ও কমান্ডার-ইন-চীফকে একথা বলার সাহস পায় যে, তোমরা এখান থেকে চলে যাও! উবায়দুল্লাহ শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর পরিবর্তন করেন।