এলোগেইছ হো হো করে হেসে ওঠল। এ হাসি মুচকি নয়-গম্ভীর। সে বলতে লাগল, আমাকে ওই শ্রেণীর পুরুষের কাতারে শামিল করো না যারা নারী সুষমায় মাতোয়ারা। তুমি যে পৌরুষে সুড়সুড়ি দিতে এসেছ তাতে আমার দেহ সজাগ হলেও হৃদয় মরে যাবে, আমার দেহ নিয়ে যেমনি কোন অনুরাগ নেই তেমনি নেই তোমার দেহের প্রতিও কোন রকম টান।
সুলতানা ঠিক এভাবে কামরা থেকে বেরোল যেন এলোগেইছই তাকে জোরপূর্বক বের করেছিল। যাবার সময় তিনি বললেন, এলোগেইছ! আমাকে তোমার অযোগ্য মনে করছ বুঝি?
যোগ্য মনে না করলে তোমাকে আমার গুপ্তরহস্য খুলে বলতাম কি? তোমাকে মহলে প্রেরণ করতাম না। তোমার অবস্থান আমার হৃদয়ে। আমি তোমার পূজারী-ভোগকারী নই। আর যাকে পূজা করা হয় তার দ্বারা জৈবিক চাহিদা নিবারণ মহাপাপ। ভোমাকে কলুষিত করা আমার অভিপ্রায় নয়। বারবার তোমাকে এই বাস্তব সত্যটি বোঝাতে চাইছি। তোমার প্রতি কোন প্রকার দুর্বলতা থাকলে আব্দুর রহমানের মহলে নয় আমার মহলেই রাখতাম তোমাকে। যে ব্যক্তি স্বার্থমোহে নারীর ওপর সওয়ার হয় তার সব কাজই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হয়ে যায় সে হায়েনা। এই একটি পয়েন্টেই আমি স্পেন রাজ আবদুর রহমানকে কুপোকাত করতে চাই। তার মত যদি আমিও নারীমাংসলোভী হয়ে উঠি তাহলে আমার সুবিশাল মিশন মাঝপথেই মুখ থুবড়ে পড়বে। এই মিশন সামনে রেখেই আমি জীবন-যৌবন জলাঞ্জলি দিয়েছি।
তুমি মহান। এলোগেইছের হাতে দুঠোঁট নামিয়ে সুলতানা বললো, তুমি যে ত্যাগ-ই চাইবে আমি তা-ই দেব। তোমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রাপ্য সেটাই। এতটুকু বলে সে বেরিয়ে গেল।
***
পরদিন। আবদুর রহমানের মহলে পৌঁছলো সুলতানা। স্পেনরাজ কল্পনাও করেননি যে সুলতানা দ্বিতীয় দিনেই ফিরে আসবে। সুলতানা আবদুর রহমানের বাহুতে নিজকে এলিয়ে দিয়ে বললেন, যেখানে এক মুহূর্ত আমাকে ছাড়া আপনার চলে না সেখানে আমার চলে কি করে রাজন? সুলতানার নারী সুষমার ঘ্রাণ আবদুর রহমানকে করে তোলে পাগলপারা। সুলতানা ওই রাতে সঙ্গীতজ্ঞ যিরাবকে আপনারে কামরায় ডেকে পাঠাল এবং তিন বাদীকে আবদুর রহমানের হাওয়ালা করল। সঙ্গীতজ্ঞকে বললেন,
তোমার কণ্ঠে যাদু আছে যিরাব! তোমার আওয়াজ শুনলে আমার শীরাতন্ত্রীতে শিহরণ জাগে। এটা কোন গোস্তাকি নয় তো৷ যিরাব জিজ্ঞাসা করেন।
না! তুমি আমায় মাতাল করে তুলেছ। তোমার নেশাদার ওই দুটি চোখ সঙ্গীতের তানে পাগল বানিয়ে ছাড়ে আমায়।
যিরাব জানতেন, সুলতানা আবদুর রহমানের-ই প্রাইভেট পাত্রী,এজন্য তিনি মাথা নীচু করে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ খামোশ থাকার পর সুলতানার কামরা থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার পর তার প্রগাঢ় ধারণা জন্মে যে, সুলতানা আবদুর রহমানের একার নয়, সে তারও। তার প্রেম তলে তলে লালন করে আসছে। এই মোলাকাতের পর তার ওই ধারণা আরো মজবুত হয়। একরাতে সুলতানা আবদুর রহমানকে বলেন, আমার জায়গীরে যেতে হবে। যিরাব থাকবে সাথে। সুলতান এমনভাবে ছুটি চাইল যেন জায়গীরের মুক্ত বাতাস সেবন না করলে তার দম আটকে যাবে। আবদুর রহমান তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিয়ে দেন।
রাতে এলোগেইছ এলো। তার সাথে সুলতানার আগে থেকেই যোগাযোগ। যিরাব সুলতানার প্রেমে এতই মজেছিল যে, স্পেন সুন্দরী পর্যন্ত চিন্তায় পড়ে গেল। তিনি যিরাবের অন্তরে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্যই প্রেমাভিনয় করেছিলো। একবার সে বললো, কেমন যেন একটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে আটকে আছি। তোমার সংগীতের কাছে বিক্রী হয়ে গেছি। আমার সৌন্দর্যও খরিদকৃত। না তুমি পলায়ন করতে পারবে, না পারব আমি। যেখানেই যাবে সেখানেই ধরা খেয়ে যাবে। এ ছাড়া সুলতানা তাকে বলে রেখেছিল, এলোগেইছ আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। মুক্তির ব্যবস্থা হলে আমরা একটি জায়গীর পেয়ে যাব। সে অবস্থায় তুমি হবে আমার উপদেষ্টা।
ওই রাতে যিরাবের সাথে এলোগেইছের সাক্ষাত। সুলতানার সাথে যিরাবের পরিচয় ঠিক এমনভাবে উপস্থাপিত হল যেন মা ও ছেলে কোন প্রানে একমত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, যিরাব নিছক একজন গায়ক-সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না বরং অসাধারণ মেধাবী ও রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু সুলতানা জগদ্দিল পাথরের মত তার মেধা-বিবেকের ওপর চেপে বসল। এতে কোন ফাঁক-ফোকর থাকলে এলোগেইছ সেটুকু পূরণ করেছিল। মোটকথা যিরাব ও সুলতানার নাচের পুতুলে পর্যবসিত হল।
শেষ পর্যন্ত এলোগেইছ তাকে বললেন, মুসলিম তাহযীব-তামাদুন বদলে দাও। যে জাতি তার তাহযীব-তামাদ্ন ভুলে যায় সে জাতি কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। অথবা এও মনে করতে পার, তারা ক্ষমতা চালানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে। জানি, এতে প্রচুর সময় লাগবে। বছর কিংবা যুগও একাজে পেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু কোন জাতিকে নিঃশেষ ও দেউলিয়া বানাতে এর বিকল্প নেই। স্পেনরাজকে আমরা প্রকাশ্য ময়দানে যুদ্ধে ডাকলে আরব থেকে অসংখ্য ফৌজ আসবে সেক্ষেত্রে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে।
সুলতানা ও এলোগেইছ কথায় কথায় যিরাবকে একটি প্রদেশের রাজা ও সুলতানাকে রাণী বানিয়ে দিল। সুলতানা যিরাবকে তিনদিন পর্যন্ত জায়গীর রাখল। স্থানটি বড়ই মনোরম। গাছ-গাছালিতে ঠাসা। ফুলে ফলে সুশোভিত। প্রানোচ্ছল। সুলতানা ও যিরাব হাত ধরাধরি করে তিনদিন ওই কানকুঞ্জে বিচরণ করল। সুলতানা নারী সুষমা আর যিব তার সঙ্গীতের সুর মূৰ্ছনা বিনিময়ের দ্বারা পরস্পরকে আকৃষ্ট করে যেতে লাগল। প্রাসাদে ফিরে আসার পর যিরাবের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় বেশ পরিবর্তন দেখা গেল। তার কণ্ঠে পূর্বেকার সুর তো ছিল, কিন্তু এর অনেকখানি দখল করেছিল সুলতানার প্রেম।